বিনীতার একদিন
আমি ফার্মগেট মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, বিনীতা আসবে। মাথায় একটা কবিতা ঘুরছে,আমার নিজেরই লেখা কবিতা। এখনো প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। কবিতাটাকে ধামাচাপা দিতে হলে,এখন একটা সিগারেট দরকার।
ফার্মগেটটার কি যা তা অবস্থা করে ফেলছে এই মেট্রো ট্রেনের চাপায় পরে। ছোট একটা পিচ্চি ছেলে সাতরাস্তার দিকে হাঁটা ধরেছে, একেই ডাকা দরকার। ছোট একটা বক্স বুকে ঝুলিয়ে রেখেছে,সেখানে চিকন কাঠে লেখা
" আমার নাম পিচ্চি না,আমি খোকন"।
ঐ খোকন,ঐ খোক.....
খোকন:- জ্বী ভাইয়া, কিছু লাগবে?
আমি: হ রে ব্যাটা,একটা সিগারেট লাগতো।
খোকন: তার জন্য দৌড়াতে হয় নাকি? সামনের দোকানেই তো আছে।
আমি: আমার তো ব্যাটা তোকে দেখেই সিগারেট টানতে মন চাচ্ছে। দে একটা টানি।
ছেলেটার মুখের হাসিটা দেখার মতো হল। এই ছেলেটার থেকেই হাতির ঝিলে দু টাকা কম দিয়ে একটা এডভান্স খেয়েছিলাম। হয়তো ওর মনে নেই,কিন্তু আমার মনে আছে তার সুন্দর মুখ খানা। ঐদিন ছিল প্রচুর বৃষ্টি, শ্রাবণীর সাথে ঘুরতে এসেছিলাম।ঝগড়ার এক পর্যায় মানিব্যাগ সহ ও চলে যায়,পকেটে ছিল ১১ টাকা। একটা দশ টাকার নোট আর এক টাকার একটা পয়সা। সে টাকা দিয়েই তার থেকে একটা সিগারেট নিয়েছিলাম। তাও পাঁচ মিনিট বুঝিয়ে।
সিগারেটটা নিয়ে আয়েশ করে দুটা টান দিলাম। মানিব্যাগটা বের করে, তার হাতে ২০ টাকা দিয়ে হাঁটা ধরলাম। তখনই চিৎকার করে বললো,"ভাইয়া আপনাকে আমি চিনে ফেলছি"।
আমি হাঁটতে হাঁটতে আবার ফুটওভার ব্রীজটার তলায় আসি। বিনীতা বলেছিল, ও এখানেই আসবে।
ফার্মগেট দারুন একটা জায়গা,এখানে দাঁড়ালে দুনিয়ার কত রঙের মানুষ যে দেখা যায়।এক একজনের মুখ খানা এক একটা গল্প বলে। আমি প্রায় সময় দেখি।সিগারেটটা প্রায় শেষ,ভাবলাম একটু বসবো। পেয়ারা বিক্রি করা লোকটার পাশের জায়গাটায় ফুঁ দিয়ে প্যান্টটায় একটা বাড়ি দিয়ে যেই না বসতে যাবো, ঠিক তখনই হাতটা খপ করে কে যেন ধরে ফেললো।
বিনীতা: তুই আবার ফাজলামু শুরু করছিস? এটা বসার জায়গা? ফালতু কোথাকার।
আমি: আরে, তুই এত দেরী করছিলি দেখে ভাবলাম মানুষ দেখি।
বিনীতা: তুই মানুষ দেখবি নাকি মেয়ে দেখার ধান্দা?
আমি: তোরা এমন কেন? শ্রাবনী একটা...!
বিনীতা: হইছে থাক আর ক্যাচলাতে হবে না। চল।
আমি: কোথায় যাবো? একটু তো মানুষ দেখতে দে,কত সুন্দর সুন্দর গল্প এক একজন মানুৃষের চেহারায়।
বিনীতা: শালারপুত, তোকে আমি খাইছি। আমার সঙ্গে আর ফিলোসোফিকাল কাপচাইস না। আমি এখনই চলে যাবো কিন্তু...!
আমি: কি বলিস তুই? ছয় মাস পরে দেখা করলি, তাও নিজ গরজে। এখন পল্টি নিচ্ছিস! খাওয়াবি নাকি? জব তো ভালোই নিয়েছিস,প্রেমিক ব্যাটাও আমার থেকে বড় মালদার পার্টি!
বিনীতা: রাস্তায় দেখে গালি দিলাম না। তোর চোদ্দগুষ্টি আমি উদ্ধার করতাম যদি এটা চ্যাট বক্স হতো।
আমি: থাম থাম,চল কোথায় যাবি।
আমি একটু থমকে দাঁড়িয়ে ওর আগাগোড়া দেখে, গেল মনটা খারাপ হয়ে। হয়তো ব্যাপারটা ও নোটিস করছে।
বিনীতা: আমি জানি, তোকে খুশি করতেই আজকে আসছি। আজকে তোকে নিয়ে সমস্ত ঢাকা শহর ঘুরব। তোর একটা স্বপ্ন আমি পুরন করব না, তা কি করে হয়?
আমি: কিন্তু বোরখা কেন?
বিনীতা: শালার ভাই,ফেসবুকে তো ঠিক ইসলামিক পোষ্ট মেরে তুফান করে ফেলো। এখন আমার বোরখা দেখে চোখ কপালে!
আমার আর কিছু বলার থাকে না। চুপ চাপ ওর সাথে হাঁটতে থাকি। ভাবতে থাকি ওর আর আমার সম্পর্কটা কেমন? আজ চার বছর ধরে একে অন্যকে চিনি। কখনো ভালোবাসা হয়নি আমাদের। হয়েছে অনেক ঝগড়া, প্রপোজ করার পর খেয়েছি গালি! ঠিক এর ভেতর সে ভেঙ্গে ফেলেছে তিনটা মানুষের সাথে সম্পর্ক। তবু আমরা এখনো এক,এই নিয়ে পাঁচ বার দেখা হল,চ্যাট বক্সেও হয়তো হায় হ্যালো ছাড়া বা নারী, ধর্ম আর প্রেমের বিষয় নিয়ে ঝগড়া ছাড়া কিছু হয়নি। কিন্তু,এখনো আমরা জানি। কার কি পছন্দ, কার সখ কি এবং কোথায় হারাতে চাই আমরা।
বিনীতা: হাসু,ঐ হাসুর বাচ্চা।
আমি: কি হয়েছে? রাস্তা ঘাটে এমন করে চিৎকার করে নাকি?
বিনীতা: তো তুই রাস্তা ঘাটে কোথায় হারিয়েছিস? রিক্সায় ওঠ।
আমি: এই দিক দিয়ে কোথায় যাবি? রাস্তায় উঠতে দেবে না। চল সংসদ ভবন হয়ে ঐ দিকটায় ঘুরি বা টিএসসির দিকে যাই।
বিনীতা: গালি খাস না,ঢাকায় আসছিস চার মাস হল আর আমাকে ঢাকা চেনাস? পুরা ঢাকা ঘোরা সম্ভব না। আমরা তেজগাঁও টা শুধু ঘুরবো। প্যাডেলের রিক্সা নিয়েছি দেখিস না?
আমি: আচ্ছা ঠিক আছে।
রিক্সায় উঠে বসতেই, হুডটা তুলে দিতে বললো বিনীতা রিক্সাওয়ালা কে।সাথে সাথে সে বোরখা খোলা শুরু করলো।
আমি: কি করছিস কি তুই?
সে তার মতোই কাজ করে যাচ্ছে। বোরখা টা খুলে আমার কোলে দিয়ে দেয়। হাল্কা ভেজা চুল,কাজল চোখ, হাত ভর্তি চুরি আর গলায় একটা চিকন স্বর্ণের জুয়েলারী। শ্যামবর্ণের মেয়েটি কালো শাড়িতে যেন এক অপ্সরী লাগছে। পারফিউমের গন্ধ আর তার চুলের গন্ধ মিলে যেন এক রোমান্টিক মোহ। আমি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তার সেই সুবাস নিচ্ছি।
বিনীতা: কি শুরু হয়ে গেছে নাকি? প্রেমিকার হলে এমন করে সুবাস নিতি, কিন্তু আমি তোর বান্ধবী। এই সুবাস নিলে, থাকতে পারবি না। অনেক তো বললি রিক্সায় ঘুরবি এমন করে একদিন। তো নিয়ে আসলাম আজকে, ঠিক থাকতে পারবি তো?
মাথাটা ঘুরিয়ে নিলাম,ফার্মগেট রেল রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। মানুষ ভাবে এক হয় অন্য রকম। আমি ভেবেছিলাম আমার কল্পনা পবিত্র। কিন্তু না, যিশুর মতো শুলে বিদ্ধ করেছে আমার কামনা; আমার পবিত্র স্বপ্ন কে। কান্না পাচ্ছে, আমি নারীকে নয় দেবীকে আহ্বান করেছিলাম এমন সাজে। কিন্তু হচ্ছে উল্টো,যেন আমার প্রেমিক আমি, অমানুষের মতো বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। সে পূজাতে বিশ্বাসী নয়। সে স্তন থেকে ঠোঁট,তারপর গলা থেকে কানের লতিতে হারাতে, আমার ভেতর অলিগলিতে ছুটে বেড়াচ্ছে।
বিনীতা: হাসু,ঐ হাসুর বাচ্চা এই দিকে দেখ। ফুলের গন্ধ মানুষকে কামুক করেনা, দৃষ্টি করে তাকে কামুক। তুই কোন দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিস? সেটাই তোকে কামনায় তাড়াচ্ছে। তাকা এই দিকে,আমি তোর স্বপ্ন নই। বাস্তবে তোর প্রেমিকা নই কিন্তু তার থেকেও বেশি কাছের।
আমি ফিরে তাকাই, নতুন করে আবিষ্কার করি। এইতো আমার অরাধ্য দেবী।যাকে আমি ভালোবাসি না,প্রেমিকাও মনে করি না। তবে আমার ভাবি,একান্তই আমার। তাই তো স্পর্শে বিশ্বাসী না। তবে গভীরের ঠিকানায় বিশ্বাসী। আমি জানি,প্রেম এবং প্রেমিকা তারপর আসে ভালোবাসা।
আমি: হুডটা নামিয়ে দে,শহরের মানুষরা শিখুক আমরাও প্রেমিক যুগল তবে মাংসে নয় বিশ্বাসে কামড়াই। আমরা কবিতায় রোমান্টিকতা নয় ঈশ্বর কে খুঁজি। মানুষ দেখুক,দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে প্রেমিক কাপুরুষ থেকে পুরুষ হয়ে ওঠে।
বিনীতা; থাম শালা,আমি তোর প্রেমিকা হলাম কখন?
আমি: সব সময়ই তো তুই আমার প্রেমিকা ছিলি।
বিনীতা: পাগলের সুখ মনে মনে ঠিক না হাসান?
আমি: হুম,পাগলের সুখ মনে মনে।হাতটা ধরতে দে,একটু ধরি।
বিনীতা: এহ আসছে আমার নাগর রে,শালা আমার প্রেমিক বসে আছে বাসায়। আজকে বিয়ে আমার,আর তুমি আসছ হাত চেক করতে?
আমি; বলিস কি? চল পালিয়ে যাই।
বিনীতা: শ্রাবণীর কি হবে তাহলে?
আমি: আরে ধুর, আমি কি বলছি নাকি সেটা।আমি বলেছি,মনে মনে পালিয়ে যাই।
দুজনই মুখ ফিরিয়ে নেই দুদিকে। হাতিরঝিলের রোডটায় গাড়ি গুলো সাঁই সাঁই করে দৌড়ে যায়। একবারও থামার বা সৌন্দর্য দেখার প্রয়োজন মনে করে না। তাদের প্রয়োজন, সৌন্দর্য যেখানে টাকার গন্ধে আমোদ। আমরা জানি,আমরা আর স্বাধীন না। বিনীতা ফিরে যাচ্ছে আমার থেকে, সে জানে আমি ভালোবেসে ছিলাম তাকে। আমিও জানি আমি তাকে এক সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু সময় বদলে গেছে, হাজার রাত্রের যুদ্ধ শেষেও আমরা দাঁড়িয়ে আছি মুক্তির মিছিলে। যাকে বলে "বন্ধু"। হারানোর অথবা হেরে যাবার ভয় নেই। আমরা জানি আমরা ফিরবো না তবুও আমরা আশায় থাকি, সব সময় বিপরীত মুখী কিন্তু জানি আমাদের ঈশ্বর এক এবং আমাদের জন্য দু হাত আমরাই তুলি তার কাছে।
আমি: যাক তাহলে প্রেমিক ব্যাটা সফল হল।
বিনীতা: এই সিগারেটটা ধরা তো।
তার ছোট পার্স থেকে একটা প্যাকেট বের করে দেয়। বুঝতে পেরেছিল হয়তো, আমার ঠোঁট গুলোয় বার বার জিহবা বোলানো দেখে।
সিগারেটটা ঠোঁটে দিতেই লাইটারটা মেরে সিগারেটটা জ্বালিয়ে দেয়।
বিনীতা: আমি অপেক্ষায় থাকবো, তুই একদিন ফিরবি সফল এবং শ্রাবণীর হয়ে। আমাকে যেমন করে চেয়েছিস, ওই মেয়েটিকেও তেমন করে চেয়ে দেখ। ঈশ্বর আমাদেরই হবেন।
আমি: তুই আজ যেমন করে পাশে বসে আছিস, আমি তোকে তেমন করেই চেয়েছিলাম। এটা আমার ভুল ছিল।
দুজনের চোখেই টলমল, বিষাদের গল্প নীরবে হয়। আনন্দের গল্প হয় চিৎকারে। প্রেমিকার মৃত্যু হয় সঙ্গমে অথবা নরকীয় কলিজা চিবিয়ে খেয়ে নেওয়াতে। আর প্রেমিক? সে তো এই কষ্ট দেখেই আত্মহত্যা করে নেয় আগে। যেন চিৎকার করতে না হয়। মদের পানিতে অথবা বিষাক্ত বায়ুতে।
বিনীতা: চল হাঁটি, তোর স্বপ্ন তো পূরন করলাম। এখন আমার হাতটা ধর, তারপর হাঁটা শুরু করবি।
রিক্সাওয়ালাকে বিদায় করে মহাখালি থেকে হাঁটতে থাকি আমরা। বিষাদময় সন্ধ্যা, যেন আমাদের গল্পটাকে লুকিয়ে রাখতেই প্যাঁচা গুলো ঝিম মেরে আছে।
কবিতাটা আবার মনে পরে যায়, আরেকটা সিগারেট ধরাই।
শহুরে মানুষ দেখছে। একটা এলোমেলো চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি আর উল্টো টি-শার্ট পরা একটা ছেলে এক অপ্সরীর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে ফুটপাত ধরে। সিগারেটের গন্ধ,আমার কাছে ফাঁসির দড়িতে আটকে থাকা মানুষের গলার মাংসের মতো লাগে।
"বিষাদময় সন্ধ্যায়
অলৌকিক এক পৃথিবীতে
অশরীরা নেমে এসেছে,
দুটি মৃত আত্মাকে তুলে নিতে।
যেন এক প্রেমের বিষাদে ছেয়ে গেছে আমাদের এই শহর আর শহুরে জীবন"।
ফার্মগেটটার কি যা তা অবস্থা করে ফেলছে এই মেট্রো ট্রেনের চাপায় পরে। ছোট একটা পিচ্চি ছেলে সাতরাস্তার দিকে হাঁটা ধরেছে, একেই ডাকা দরকার। ছোট একটা বক্স বুকে ঝুলিয়ে রেখেছে,সেখানে চিকন কাঠে লেখা
" আমার নাম পিচ্চি না,আমি খোকন"।
ঐ খোকন,ঐ খোক.....
খোকন:- জ্বী ভাইয়া, কিছু লাগবে?
আমি: হ রে ব্যাটা,একটা সিগারেট লাগতো।
খোকন: তার জন্য দৌড়াতে হয় নাকি? সামনের দোকানেই তো আছে।
আমি: আমার তো ব্যাটা তোকে দেখেই সিগারেট টানতে মন চাচ্ছে। দে একটা টানি।
ছেলেটার মুখের হাসিটা দেখার মতো হল। এই ছেলেটার থেকেই হাতির ঝিলে দু টাকা কম দিয়ে একটা এডভান্স খেয়েছিলাম। হয়তো ওর মনে নেই,কিন্তু আমার মনে আছে তার সুন্দর মুখ খানা। ঐদিন ছিল প্রচুর বৃষ্টি, শ্রাবণীর সাথে ঘুরতে এসেছিলাম।ঝগড়ার এক পর্যায় মানিব্যাগ সহ ও চলে যায়,পকেটে ছিল ১১ টাকা। একটা দশ টাকার নোট আর এক টাকার একটা পয়সা। সে টাকা দিয়েই তার থেকে একটা সিগারেট নিয়েছিলাম। তাও পাঁচ মিনিট বুঝিয়ে।
সিগারেটটা নিয়ে আয়েশ করে দুটা টান দিলাম। মানিব্যাগটা বের করে, তার হাতে ২০ টাকা দিয়ে হাঁটা ধরলাম। তখনই চিৎকার করে বললো,"ভাইয়া আপনাকে আমি চিনে ফেলছি"।
আমি হাঁটতে হাঁটতে আবার ফুটওভার ব্রীজটার তলায় আসি। বিনীতা বলেছিল, ও এখানেই আসবে।
ফার্মগেট দারুন একটা জায়গা,এখানে দাঁড়ালে দুনিয়ার কত রঙের মানুষ যে দেখা যায়।এক একজনের মুখ খানা এক একটা গল্প বলে। আমি প্রায় সময় দেখি।সিগারেটটা প্রায় শেষ,ভাবলাম একটু বসবো। পেয়ারা বিক্রি করা লোকটার পাশের জায়গাটায় ফুঁ দিয়ে প্যান্টটায় একটা বাড়ি দিয়ে যেই না বসতে যাবো, ঠিক তখনই হাতটা খপ করে কে যেন ধরে ফেললো।
বিনীতা: তুই আবার ফাজলামু শুরু করছিস? এটা বসার জায়গা? ফালতু কোথাকার।
আমি: আরে, তুই এত দেরী করছিলি দেখে ভাবলাম মানুষ দেখি।
বিনীতা: তুই মানুষ দেখবি নাকি মেয়ে দেখার ধান্দা?
আমি: তোরা এমন কেন? শ্রাবনী একটা...!
বিনীতা: হইছে থাক আর ক্যাচলাতে হবে না। চল।
আমি: কোথায় যাবো? একটু তো মানুষ দেখতে দে,কত সুন্দর সুন্দর গল্প এক একজন মানুৃষের চেহারায়।
বিনীতা: শালারপুত, তোকে আমি খাইছি। আমার সঙ্গে আর ফিলোসোফিকাল কাপচাইস না। আমি এখনই চলে যাবো কিন্তু...!
আমি: কি বলিস তুই? ছয় মাস পরে দেখা করলি, তাও নিজ গরজে। এখন পল্টি নিচ্ছিস! খাওয়াবি নাকি? জব তো ভালোই নিয়েছিস,প্রেমিক ব্যাটাও আমার থেকে বড় মালদার পার্টি!
বিনীতা: রাস্তায় দেখে গালি দিলাম না। তোর চোদ্দগুষ্টি আমি উদ্ধার করতাম যদি এটা চ্যাট বক্স হতো।
আমি: থাম থাম,চল কোথায় যাবি।
আমি একটু থমকে দাঁড়িয়ে ওর আগাগোড়া দেখে, গেল মনটা খারাপ হয়ে। হয়তো ব্যাপারটা ও নোটিস করছে।
বিনীতা: আমি জানি, তোকে খুশি করতেই আজকে আসছি। আজকে তোকে নিয়ে সমস্ত ঢাকা শহর ঘুরব। তোর একটা স্বপ্ন আমি পুরন করব না, তা কি করে হয়?
আমি: কিন্তু বোরখা কেন?
বিনীতা: শালার ভাই,ফেসবুকে তো ঠিক ইসলামিক পোষ্ট মেরে তুফান করে ফেলো। এখন আমার বোরখা দেখে চোখ কপালে!
আমার আর কিছু বলার থাকে না। চুপ চাপ ওর সাথে হাঁটতে থাকি। ভাবতে থাকি ওর আর আমার সম্পর্কটা কেমন? আজ চার বছর ধরে একে অন্যকে চিনি। কখনো ভালোবাসা হয়নি আমাদের। হয়েছে অনেক ঝগড়া, প্রপোজ করার পর খেয়েছি গালি! ঠিক এর ভেতর সে ভেঙ্গে ফেলেছে তিনটা মানুষের সাথে সম্পর্ক। তবু আমরা এখনো এক,এই নিয়ে পাঁচ বার দেখা হল,চ্যাট বক্সেও হয়তো হায় হ্যালো ছাড়া বা নারী, ধর্ম আর প্রেমের বিষয় নিয়ে ঝগড়া ছাড়া কিছু হয়নি। কিন্তু,এখনো আমরা জানি। কার কি পছন্দ, কার সখ কি এবং কোথায় হারাতে চাই আমরা।
বিনীতা: হাসু,ঐ হাসুর বাচ্চা।
আমি: কি হয়েছে? রাস্তা ঘাটে এমন করে চিৎকার করে নাকি?
বিনীতা: তো তুই রাস্তা ঘাটে কোথায় হারিয়েছিস? রিক্সায় ওঠ।
আমি: এই দিক দিয়ে কোথায় যাবি? রাস্তায় উঠতে দেবে না। চল সংসদ ভবন হয়ে ঐ দিকটায় ঘুরি বা টিএসসির দিকে যাই।
বিনীতা: গালি খাস না,ঢাকায় আসছিস চার মাস হল আর আমাকে ঢাকা চেনাস? পুরা ঢাকা ঘোরা সম্ভব না। আমরা তেজগাঁও টা শুধু ঘুরবো। প্যাডেলের রিক্সা নিয়েছি দেখিস না?
আমি: আচ্ছা ঠিক আছে।
রিক্সায় উঠে বসতেই, হুডটা তুলে দিতে বললো বিনীতা রিক্সাওয়ালা কে।সাথে সাথে সে বোরখা খোলা শুরু করলো।
আমি: কি করছিস কি তুই?
সে তার মতোই কাজ করে যাচ্ছে। বোরখা টা খুলে আমার কোলে দিয়ে দেয়। হাল্কা ভেজা চুল,কাজল চোখ, হাত ভর্তি চুরি আর গলায় একটা চিকন স্বর্ণের জুয়েলারী। শ্যামবর্ণের মেয়েটি কালো শাড়িতে যেন এক অপ্সরী লাগছে। পারফিউমের গন্ধ আর তার চুলের গন্ধ মিলে যেন এক রোমান্টিক মোহ। আমি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তার সেই সুবাস নিচ্ছি।
বিনীতা: কি শুরু হয়ে গেছে নাকি? প্রেমিকার হলে এমন করে সুবাস নিতি, কিন্তু আমি তোর বান্ধবী। এই সুবাস নিলে, থাকতে পারবি না। অনেক তো বললি রিক্সায় ঘুরবি এমন করে একদিন। তো নিয়ে আসলাম আজকে, ঠিক থাকতে পারবি তো?
মাথাটা ঘুরিয়ে নিলাম,ফার্মগেট রেল রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। মানুষ ভাবে এক হয় অন্য রকম। আমি ভেবেছিলাম আমার কল্পনা পবিত্র। কিন্তু না, যিশুর মতো শুলে বিদ্ধ করেছে আমার কামনা; আমার পবিত্র স্বপ্ন কে। কান্না পাচ্ছে, আমি নারীকে নয় দেবীকে আহ্বান করেছিলাম এমন সাজে। কিন্তু হচ্ছে উল্টো,যেন আমার প্রেমিক আমি, অমানুষের মতো বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। সে পূজাতে বিশ্বাসী নয়। সে স্তন থেকে ঠোঁট,তারপর গলা থেকে কানের লতিতে হারাতে, আমার ভেতর অলিগলিতে ছুটে বেড়াচ্ছে।
বিনীতা: হাসু,ঐ হাসুর বাচ্চা এই দিকে দেখ। ফুলের গন্ধ মানুষকে কামুক করেনা, দৃষ্টি করে তাকে কামুক। তুই কোন দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিস? সেটাই তোকে কামনায় তাড়াচ্ছে। তাকা এই দিকে,আমি তোর স্বপ্ন নই। বাস্তবে তোর প্রেমিকা নই কিন্তু তার থেকেও বেশি কাছের।
আমি ফিরে তাকাই, নতুন করে আবিষ্কার করি। এইতো আমার অরাধ্য দেবী।যাকে আমি ভালোবাসি না,প্রেমিকাও মনে করি না। তবে আমার ভাবি,একান্তই আমার। তাই তো স্পর্শে বিশ্বাসী না। তবে গভীরের ঠিকানায় বিশ্বাসী। আমি জানি,প্রেম এবং প্রেমিকা তারপর আসে ভালোবাসা।
আমি: হুডটা নামিয়ে দে,শহরের মানুষরা শিখুক আমরাও প্রেমিক যুগল তবে মাংসে নয় বিশ্বাসে কামড়াই। আমরা কবিতায় রোমান্টিকতা নয় ঈশ্বর কে খুঁজি। মানুষ দেখুক,দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে প্রেমিক কাপুরুষ থেকে পুরুষ হয়ে ওঠে।
বিনীতা; থাম শালা,আমি তোর প্রেমিকা হলাম কখন?
আমি: সব সময়ই তো তুই আমার প্রেমিকা ছিলি।
বিনীতা: পাগলের সুখ মনে মনে ঠিক না হাসান?
আমি: হুম,পাগলের সুখ মনে মনে।হাতটা ধরতে দে,একটু ধরি।
বিনীতা: এহ আসছে আমার নাগর রে,শালা আমার প্রেমিক বসে আছে বাসায়। আজকে বিয়ে আমার,আর তুমি আসছ হাত চেক করতে?
আমি; বলিস কি? চল পালিয়ে যাই।
বিনীতা: শ্রাবণীর কি হবে তাহলে?
আমি: আরে ধুর, আমি কি বলছি নাকি সেটা।আমি বলেছি,মনে মনে পালিয়ে যাই।
দুজনই মুখ ফিরিয়ে নেই দুদিকে। হাতিরঝিলের রোডটায় গাড়ি গুলো সাঁই সাঁই করে দৌড়ে যায়। একবারও থামার বা সৌন্দর্য দেখার প্রয়োজন মনে করে না। তাদের প্রয়োজন, সৌন্দর্য যেখানে টাকার গন্ধে আমোদ। আমরা জানি,আমরা আর স্বাধীন না। বিনীতা ফিরে যাচ্ছে আমার থেকে, সে জানে আমি ভালোবেসে ছিলাম তাকে। আমিও জানি আমি তাকে এক সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু সময় বদলে গেছে, হাজার রাত্রের যুদ্ধ শেষেও আমরা দাঁড়িয়ে আছি মুক্তির মিছিলে। যাকে বলে "বন্ধু"। হারানোর অথবা হেরে যাবার ভয় নেই। আমরা জানি আমরা ফিরবো না তবুও আমরা আশায় থাকি, সব সময় বিপরীত মুখী কিন্তু জানি আমাদের ঈশ্বর এক এবং আমাদের জন্য দু হাত আমরাই তুলি তার কাছে।
আমি: যাক তাহলে প্রেমিক ব্যাটা সফল হল।
বিনীতা: এই সিগারেটটা ধরা তো।
তার ছোট পার্স থেকে একটা প্যাকেট বের করে দেয়। বুঝতে পেরেছিল হয়তো, আমার ঠোঁট গুলোয় বার বার জিহবা বোলানো দেখে।
সিগারেটটা ঠোঁটে দিতেই লাইটারটা মেরে সিগারেটটা জ্বালিয়ে দেয়।
বিনীতা: আমি অপেক্ষায় থাকবো, তুই একদিন ফিরবি সফল এবং শ্রাবণীর হয়ে। আমাকে যেমন করে চেয়েছিস, ওই মেয়েটিকেও তেমন করে চেয়ে দেখ। ঈশ্বর আমাদেরই হবেন।
আমি: তুই আজ যেমন করে পাশে বসে আছিস, আমি তোকে তেমন করেই চেয়েছিলাম। এটা আমার ভুল ছিল।
দুজনের চোখেই টলমল, বিষাদের গল্প নীরবে হয়। আনন্দের গল্প হয় চিৎকারে। প্রেমিকার মৃত্যু হয় সঙ্গমে অথবা নরকীয় কলিজা চিবিয়ে খেয়ে নেওয়াতে। আর প্রেমিক? সে তো এই কষ্ট দেখেই আত্মহত্যা করে নেয় আগে। যেন চিৎকার করতে না হয়। মদের পানিতে অথবা বিষাক্ত বায়ুতে।
বিনীতা: চল হাঁটি, তোর স্বপ্ন তো পূরন করলাম। এখন আমার হাতটা ধর, তারপর হাঁটা শুরু করবি।
রিক্সাওয়ালাকে বিদায় করে মহাখালি থেকে হাঁটতে থাকি আমরা। বিষাদময় সন্ধ্যা, যেন আমাদের গল্পটাকে লুকিয়ে রাখতেই প্যাঁচা গুলো ঝিম মেরে আছে।
কবিতাটা আবার মনে পরে যায়, আরেকটা সিগারেট ধরাই।
শহুরে মানুষ দেখছে। একটা এলোমেলো চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি আর উল্টো টি-শার্ট পরা একটা ছেলে এক অপ্সরীর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে ফুটপাত ধরে। সিগারেটের গন্ধ,আমার কাছে ফাঁসির দড়িতে আটকে থাকা মানুষের গলার মাংসের মতো লাগে।
"বিষাদময় সন্ধ্যায়
অলৌকিক এক পৃথিবীতে
অশরীরা নেমে এসেছে,
দুটি মৃত আত্মাকে তুলে নিতে।
যেন এক প্রেমের বিষাদে ছেয়ে গেছে আমাদের এই শহর আর শহুরে জীবন"।
-রেজাউল করিম
2 Comments
জল্পনা কল্পনা সুন্দর হয়েছে কবি সাহেব!♥️
ReplyDeleteধন্যবাদ😍😍
Delete