অজ্ঞাতনামা
আমি হাঁটছিলাম একটা নির্জন বনভূমির পাশে দিয়ে, হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে দৌড়ে গেলাম। দেখি নদীর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মেহগনি গাছটার সাথে একটা নারীর মরদেহ পরে আছে,মাথাটা থেঁতলে আছে। যেন সময় পায়নি আসামী,সময় থাকলে নারীর মুখমণ্ডল টাও চেনার অবস্থায় ছেড়ে যেত না।
:তা তুমি রাত তিনটার সময় ওই জায়গায় হাঁটতে গিয়েছিলে কেন? এত রাত্রে তো মানুষ এই সব জায়গায় যায়না।
-আমার মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়,তখন হাঁটতে বের হই। তেমনি ভাবে আমিও হাঁটতে বের হয়েছিলাম।
:মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয়?
-হুম, মাঝে মাঝেই হয়।
:মাঝে মাঝে নাকি প্রায় সময়?
তীক্ষ্ণ ভাবে তাকায় তার দিকে সব থেকে বেষ্ট ইন্টারোগেশন করা মানুষটি। তার নাম সমস্ত শহরের পুলিশ ডির্পাটমেন্টের লোকদের মুখস্থ। যারাই এই পেশায় আসতে চায়,তারাই তাকে আইডল মনে করে। সুর্হায, আবার আগাগোড়া একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। কোথায় যেন সুর কেটে যাচ্ছে।
-জ্বী আপনি ঠিক বলেছেন,প্রায় সময়ই আমার মন খারাপ হয়। তাই রাত্রে বের হই।
:একলাই বের হন? নাকি সাথে আরও কেউ থাকে?
-না,আমি একলাই বের হই। মানুষের সঙ্গ আর ভালো লাগে না।
:আচ্ছা,আপনার বাসায় কে কে আছে?
-আমি,আমার স্ত্রী আর ওর বাবা।
:আপনার পক্ষের কেউ নেই?
-জ্বী না,আমি ওদের ওইখানে ঘর জামাই থাকি।
সুহার্য যেন এখন একটা তাল পাচ্ছে সুরে।তাল লয় সবই ফিরে আসছে।
:আচ্ছা,আপনার ঠিকানাটা লিখে যান। সামনে যদি এই কেসের জন্য কোনো দরকার হয় যোগাযোগ করবো।
-জ্বী আচ্ছা।
:ওহ, হ্যাঁ আপনার পেশা কি?
-আমি এক সময় সার্জন ছিলাম। এখন সব ছেড়ে ঘরে বসে থাকি আর স্ত্রীর কথা শুনি।
:হুম।বুঝতে পেরেছি আপনার কষ্ট।
-আমার ঠিকানা কি দিব? আপনারা প্রয়োজন হলে চলে আসবেন। শিল্পপতি আমিন সাহেবের বাড়িতে।
:ওহ হ্যাঁ,তাহলে তো হলোই।
বার বার "স্ত্রীর কথা শুনি" এই শব্দ গুলো মাথায় ঘুরছে সুহার্যের। তার তো আজকে বিবাহ বার্ষিকী। রিয়া পাই পাই করে বলে দিয়েছিল ৭ টার আগে বাসায় যেতে এখন বাজে রাত ১০টা। নিজেই নিজের কপাল চাপড়াতে মন চাচ্ছে। সমস্ত দেশের বড় বড় মাথা গুলো, আমার সামনে মাথা চাপড়ায় আর আমি একজন রিয়ার সামনে..! কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে,তাড়াতাড়ি গাড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। দেরী যখন হয়েই গেছে যাই শাহবাগের দিকে যাই,হয়তো একটু না হয় আরও দেরী হবে। যাই গিয়ে কিছু কিনে নিয়ে আসি।
বেশি সময় লাগে নি সুর্হাযের শাহবাগ পৌঁছাতে। পৌঁছেই যেই না ফুল কিনে গাড়িতে উঠবে। তখনই পেছন থেকে একজন শার্ট ধরে টেনে ধরে।
-আরে সুর্হায না তুই?
:হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?
-আমি কে মানে? হোয়াট দ্য ফাক ম্যান।তুই আমাকে ভুলে গেছিস?
কন্ঠ টা কেমন চেনা চেনা লাগছে। বাট মুখটা চেনা চেনা লাগছে না। ফিগার টা তো শাহিনার মতো লাগছে।
:শাহিনা? তুই এত রাত্রে এখানে কেন?
-যাক বাবা চিনেছিস তাহলে?
:হ্যাঁ চিনেছি। তুই আগে বল এত রাত্রে এখানে কি করছিস? সায়েম কোথায়?
-আরে ফাউল এত প্রশ্ন এক সাথে করলে হবে নাকি? আমি তো অপরাধী না,আমি তোর বন্ধু।
:ওহ, হ্যাঁ আমার তাড়া আছে রে। রিয়া খেপে আছে,আজকে আমাদের বিবাহবার্ষিকী কিন্তু কথা দিয়েছিলাম ৭ টায় ফিরবো আর এখনও আমি এখানে।
-হুম বুঝেছি, তোদের পুরুষদের এই সমস্যা। করবি ঠিকই নারীর কথা মতো সব বাট সেটা বকা খেয়ে বা চিপায় পরে, তার আগে না।
:আচ্ছা, তুইও চলনা বাসায়। এক সাথে সব করলাম। সায়েম কোথায়?
-ওই যে বিড়ি ফুঁকছে।
:শালারপুতের না বলে হুগের ভেতর সমস্যা আবার বিড়ি খেতে দিস কেন? যতসব।
-আরে ব্যাটা দিনে একটা বা দুটা খায় তাই কিছু বলিনা।আচ্ছা, দাঁড়া ওকে ডাকি।
:না থাক, তোমার যে পায়ের ক্ষমতা আর শরীর বানিয়েছ। রাত কেটে যাবে ওর কাছে যেতে আর এমন করে শত খানেক লেয়ার মারার কি দরকার? তুই কি এমনি কম সুন্দর? যতসব আজব পাবলিক।
-রেগে যাচ্ছিস কেন সুহার্য?
:রাগবো না তো কি করবো?
-বলতে বলতে হাঁটা ধরে,সায়েমের দিকে।
কানে ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসে।
রাত ১১ টা, নিকেতনে আমিন ভিলার সামনে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গেটের দাড়োয়ান তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়। তার শাফিনের শ্বশুর আমিন সাহেব যদিও বৃদ্ধ হয়ে গেছেন তবুও হাঁটা চলা করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা আছে।
-কি শাফিন কোথায় ছিলে এতদিন?
:জ্বী বাবা,আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম। এক বন্ধুর সাথে বইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। থিমটাও ন্যাচার নিয়ে তাই রাঙামাটি ঘুরেও আসলাম।
-কিন্তু এই দিকের খোঁজ তো রাখো একটু। সামিয়াকে গত দুদিন ধরে কোথাও পাচ্ছিনা।
:কি বলেন বাবা?
-হ্যাঁ, তোমাকে কতবার বললাম ফোন ব্যবহার করতে, না তা করো না। আমি বৃদ্ধ মানুষ কি করে খুঁজি? পরে ভাবলাম হয়তো তোমার সাথে গেছে। তাই পুলিশ কমপ্লেইনও করিনি।
:আমার তো মনে হয়, আপনার বন্ধুর ছেলের সাথেই আছে। এত প্যারা নিচ্ছেন কেন?এটা তো নতুন কিছু না।
-না, রকি মারা গেছে, সামিয়া যেদিন বাসা থেকে বের হয়, ওইদিন রাত্রেই।
:কি বলেন কি ভাবে?
-কারা যেন তার মুখ পাথর দিয়ে থেঁতলে দেয়। সাথে যত টাকা পয়সা ছিল সব নিয়ে গেছে।
:ইশ এমন করে মারা দরকারই ছিল না। মনে হয় পুরোনো শত্রুতা ধরেই খুন করেছে।
-হুম সেটা ধরেই পুলিশ তদন্ত করছে।
:আচ্ছা, তাহলে একটা পুলিশ কমপ্লেইন করে দিন। আমি খুব ক্লান্ত। গত কালকে পুলিশদের একটা লাশ খুঁজে দিয়েছিলাম। তার ফলে তারা একদিন আমাকে আটকে রাখে। আজকে ইন্টারোগেশন শেষ করে ছাড়ে। আমার গোসল করা দরকার। খেতে হবে কিছু।
এমন ব্যবহারের সাথে পরিচিত আমিন সাহেব। এটা নতুন কিছু না শাফিনের থেকে। হয়তো নিজের হাতে মানুষ মরতে-বাঁচতে দেখতে দেখতে শিখে গেছে কেমন করে নিজের নার্ভকে শীতল রাখতে হয়। তাছাড়া সামিয়া আর রকির কাজ কর্ম নিজের চোখে ধরার পর যেন শাফিন আরও বদলে যায়। নিজের ভালোবেসে বিয়ে করা স্ত্রীকে যখন অন্য কারোর সাথে নিজের বিছানায়ই আবিষ্কার করে, তখন সেই পুরুষের কেমন লাগবে তা অজানা নয় কারোর।সাত বছর প্রেম তারপর বিয়ে করে। পাঁচ বছর পর সামিয়া এমন ভাবে ধরা পরে শাফিনের হাতে। হয়তো সেই ধাক্কাই তাকে বদলে দিয়েছে।
চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে ফিরে আসে অফিসে সুর্হায। আলী, তাকে দেখেই হেসে উঠে।
-কি স্যার গত রাত্রেও কি দরজার বাইরে কাটিয়েছেন?
:সাথে সাথে মনে পরে যায়,গত কালকে কি করেছিল রিয়া ওর সাথে। সায়েম আর শাহেনারে নিয়ে মজা করেছিল আর তাকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সারা রাত। সকালে দরজা খুলে নতুন শার্ট আর একটা টাই গিফট করে আর বলে আজকেও যেন বাসায় না ফিরি। যদি ঘরের সামনে দেখেছে তবে সুহার্যের খবর আছে। এমন ভাবেই শুরু হয় দিন। কি যে যন্ত্রনা, এক তো প্রেম করে বিয়ে আবার সাংবাদিক বৌ। কার না কপালে শনি থাকবে?
-আমাদের হাতে নতুন একটা কেস এসেছে। এখন আপনার ইন্টারোগেশন থেকেও মাথা খেলাতে হবে বেশি। আর দ্রুত সমাধানও করতে হবে। কেসটা শিল্পপতির একমাত্র মেয়ে সামিয়া গত তিন দিন ধরে নিখোঁজ।
উপরের মহল থেকেই আসছে কেসটা, যদিও নরমাল কমপ্লেইন তবুও জানিনা উপরে থেকে ওনারা কেন ওনাকে খুশি করতে এত দৌড়াচ্ছেন।
:হুম,শিল্পপতি বলে কথা। দুদিন পর নির্বাচন। খুশি করতে পারলেই তো হল। তা এখন কি আমার আবার গোয়েন্দা হতে হবে নাকি?
সবাই হেসে উঠে এবং এক বাক্যেই বলে উঠে, "জ্বী স্যার"।
:আচ্ছা ঠিক আছে, ঈগল আসো আমার সাথে আর পিএস তুমি মেয়েটার সম্পুর্ণ প্রোফাইল তৈরী করো। বাকিরা গতদিনের ওই অজ্ঞাতনামা কেসটার উপর নজর রাখো।
-জ্বী স্যার।
আমিন সাহেবের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুহার্য বলে উঠে,
-এই ওর স্বামী না শাফিন? ওই যে লোকটাকে কালকে ইন্টারোগেশন করলাম?
:জ্বী স্যার। এটাই সেটা, বলে ওঠে ঈগল।
-নজর ঠিক মতো রেখো। আমার সব কিছুই কেমন এলোমেলো লাগছে।
:ঠিক আছে স্যার।
-পারলে ওদের দুজনেরই চুল কালেক্ট করে নিও তো।
:অবাক হয়ে তাকায় ঈগল। তারপর কয়েক ন্যানো সেকেন্ড পরই বুঝতে পারে কি বোঝাতে চেয়েছে সুহার্য ।
বাড়ির তো নয় যেন রাজপ্রসাদ। নাস্তার টেবিলে নাস্তা ভর্তি। দুজন মানুষ কিন্তু কর্মচারীর অভাব নাই।
এখন যেন নতুন করে শাফিনকে দেখতে পায়। একবারেই ভিন্ন একজন মানুষ। সুদর্শন বললেও কম হয়ে যাবে। সামনে বসে আছে বৃদ্ধ আমিন সাহেব।
-আমার কিছু প্রশ্ন আছে আপনাদের কাছে। আশা করি সব ঠিকঠাক জবাব দিবেন।
দুজনই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
ঈগল হাঁটতে হাঁটতে ভেতরের রুম গুলো চেক করে। যেন বোঝাতে চাচ্ছে বাড়িটা দেখে সে অবাক। তাই আরও সুন্দর করে দেখতে চায়।
-বিশেষ করে শাফিন সাহব,আপনি কোথায় ছিলেন যখন আপনার স্ত্রী বাইরে যায়?
:আমি তারও আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই, প্রায় আপনার সাথে দেখা হবার ৭ দিন আগে।
-কে ছিল আপনার সাথে?
:আমার সাথে কেউ থাকে না,আমি একলাই ঘোরাঘুরি করি। কিন্তু এইবার চিটাং এর একজন বন্ধু ছিল। মিশু, সে আমার সাথে রাঙামাটিতে গিয়েছিল। সেই তার গাড়িতে করে আমাকে নামিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। তাই ওই পার্কের দিকে ঘুরতে যাই। তারপর ওই লাশটা আবিষ্কার করি এবং আপনাকে জানাই।
-হুম,ঠিক আছে।তা আপনার কি মনে হয় কোথায় যেতে পারে?
:আমার জানা মতে তার রকির সাথে যাবার কথা। কিন্তু রকি যেহেতু মারা গেছে,যেদিন রাত্রে সে বাড়ি থেকে যায় তারপর দিন সকালেই রকির নাকি লাশ পাওয়া যায় আমার শ্বশুর বললেন। তাহলে বাকিটুকু আমি জানি না।
-রকি মানে? ওই যে গাড়ি চাপা পড়ে খুব বিশ্রী ভাবে মারা যায় সে?
:হুম।
-আপনার কি ধারণা আমিন সাহবে?
:আমিও একমত শাফিনের সাথে। তবে কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছে কুকুর কামড়ালে কুকুর কে কামড়ানোর অভ্যাস থেকে যায় গরীব ঘরের ছেলেদের। এরা বুঝতে চায়না, কুকুরের কাজই কামড়ানো, আমাদের কাজ এন্টিবায়োটিক নেওয়া।
-বুঝলাম না সঠিক।
শাফিনের গাল, চোখ, মুখ লাল হয় উঠে।
তখনই সুহার্য বুঝতে পারে,শ্বশুর কাকে সন্দেহ করছে। সহজ কিছু পয়েন্ট হাতে চলে আসছে। মেয়েটার পরকিয়া ছিল রকির সাথে,তার মানে রকি এক্সিডেন্টে মারা যায়নি। এটা খুন ছিল,আমার সন্দেহই সঠিক।
ধন্যবাদ,আমরা চেষ্টা করব আমাদের সর্বোত্তম টা দিয়ে। বাকিটা আল্লাহর হাতে।
আমিন সাহেব বলে ওঠেন, "জ্বী তাই করেন পুলিশ সাহবে"।
কর্মোদ্ধার করে নিচে নেমে আসে ঈগল আর সুহার্য।
-কি হল সব?
:জ্বী,চুল বের করতে পেরেছি।
-ঠিক আছে ল্যাবে পাঠিয়ে দাও।
অফিসে ফিরে আসতেই দেখতে পায় ডেস্কে একটা টিফিন বক্স। সবাই মুচকি হাসছে তার মানে রিয়া এসেছে এখানে। টিফিন বক্সের নিচে ছোট একটা চিরকুট-
" আমাকে ভালোবাসছো আবার অবহেলা দিবে!
সেটার দুঃখ ভোগ করবে না তা হয়? আর দেরী করলে দু দিন ঘরের দরজায় পা রাখতে দিব না। ঠিক মতো খেয়ে নিও,আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে আজকে মনে থাকে যেন। "
খাবার টুকু খেয়ে বের হয়ে আসে নিজের ছোট রুমটা থেকে।
-কি হল পিএস? সব রেডি?
:জ্বী স্যার।
-তো বলো কি কি করলে?
:মেয়েটার একটা বড় ফটো পর্দায় ভেসে ওঠে।
তারপর সব কিছু বলতে শুরু করে।
মেয়েটা একটা নাম করা কলেজের প্রফেসর ছিল। তার এবং শাফিনের ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু হুট করে গত এক বছর ধরে তাদের সম্পর্কের মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় রকি নামের ছেলেটা। সে শিল্পপতি রায়হান খানের ছেলে,সামিয়া আর রকির ভেতর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল আগে থেকেই। কিন্তু যখন শাফিন লেখা লেখি করার জন্য সার্জনের পদ ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে শুরু করে, তখনই সামিয়া রকির দিকে ঝুঁকে যায়। কিন্তু সেটা শুধু ঝোঁকাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। বলা যায় নোংরা। আমরা কাজের লোকদের থেকে যা জানতে পেরেছি তা খুবই ভয়ংকর। শাফিনের বাচ্চা ছিল সামিয়ার গর্ভে কিন্তু রকির জন্য সে সেটাকে পৃথিবীর মুখ দেখতে দেয়নি । এবরশন করে শাফিন কে জানায় সে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ায় বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়। তারপর সামিয়া ও রকি কয়েকবারই হাতে নাতে তাদের বিছানায় ধরা পরে শাফিনের কাছে। কিন্ত শাফিন কেন তাকে ছাড়েনি বা কেন দূরে যায়নি আমরা জানি না। তবে সামিয়ার নোংরামী এত বেশি ছিল বা এত ফ্যান্টাসিতে ছিল যে, ঘরে একজন বৃদ্ধ আছে বা তার বাবা আছে সেটাও ভুলে যেত।
যার ফল হঠাৎ সে হারিয়ে যায়।
-অনেক বেশি করেছ তোমরা আজকে,এই জন্যই আমরা আজও বাংলাদেশের প্রথম গোয়েন্দা যারা কখনো কোনো কেস হারিনি।
চলো কাজ চালিয়ে যাও,আমি বাইরে যাই।
রাত প্রায় তিনটা, রিয়া ঘুমিয়ে আছে। সুহার্য এর ঘুম আসছে না। মাথায় কয়েকটা শব্দ ঘুরছে। মেকআপ করা শাহিনার মুখ আর সার্জন শাফিন আর তার শ্বশুরের বলা কথাটা। একটা জিনিস সত্যি, কুকুর যখন বাচ্চাদের কামড়াতে আসে তখন তারা কামড়াতে যাবেই। গরীব বলতে শাফিন কে বুঝিয়েছে। কিন্তু বার বার সার্জন আর মেকআপ কেন মাথায় ঘুরছে?
হঠাৎ ডিম লাইটের আলোতে রিয়ার মুখটার দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে উঠে। রিয়া কৃত্তিম একটা তিল দেয় তার নাকের বাম সাইডে যেটা সুহার্যের খুব প্রিয়। তখনই একটু হলেও পরিবর্তন লাগে তাকে।
তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নেয়।
দুবার রিং হবার পর কলটা রিসিভ হয়।
-হ্যালো সার্জন?
:জ্বী স্যার।
-তাড়াতাড়ি তুমি সামিয়ার ময়নাতদন্তের রুমে যাও।
:সামিয়া মানে কি বলতে চাচ্ছেন স্যার?
-আরে ধুর,অজ্ঞাতনামা লাশটার কাছে যাও। গিয়ে তার মুখের চামড়াটা টেষ্ট করে দেখো তো। সেটা কি সার্জারি করে লাগানো নাকি আসল। দ্রুত যাও।
:আমাকে একটু ঘুমাতেও দিবেন না?
-দিব,আগে কাজটা করো। তারপর দুদিনের ছুটি।
:সত্যি?
-হুম সত্যি।
রিয়া সুহার্যের গলার স্বর শুনে ঘুম থেকে উঠে বসে। ব্রা টা ঝুলে আছে বুকে।হাল্কা আলোয় যেন আরও অপরুপ লাগছে তাকে। রিয়ার দিকে সুর্হাযের তাকানো দেখে তাড়াতাড়ি বুক ঢেকে বসে।
-ভুলেও না।
:একটু প্লীজ
-না বলেছি, ঠিক মামলা করে দিব আর একটু এগোলে।
:এমন করো কেন?একটু প্লীজ।
-দূর হ খাটাস, সামনে আসবি না। ভূত চেপেছে এই শেষ রাত্রে।
মুখ কালো করে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে পরে সুহার্য।রিয়া পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে।
সকাল না হতেই গাড়ি নিয়ে হাজির হয়ে যায় অফিসে সুহার্য। ফাইল একটা হাতে ফিরে আসে সার্জন। তাদের টিমেরই সব, একই টিমে সব সদস্য ভর্তি, এরা যেমন গুলি চালাতে পারে তেমনি পারে ডিপ নাইফ ১৫ ও চালাতে।
-জ্বী স্যার আপনিই রাইট। তাকে প্লাষ্টিক সার্জারি করা হয়েছে। যার কারনে শুধু মুখমণ্ডল টা ঠিক রেখে শরীরের সমস্ত অঙ্গ গুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে সাজিয়ে রাখে।
কেসটা সমাধান হয়ে গেল দুদিনে।
দুজনই হেসে উঠে।
-ঠিক আছে,তাহলে শাফিনকে এরেষ্ট করো। দুটি খুনের আসামী হিসেবে।
আর লাশটি সামিয়ার নামে তার বাড়িতে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করো।
সমস্ত টিভি চ্যানেল গুলোতে একটাই নিউজ। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন। রসিয়ে রসিয়ে খবর পড়ছেন নিউজ প্রেজেন্টাররা।
আমিন সাহেব মুচকি হাসছেন আর একটা মদের পাত্র থেকে মদ ঢেলে দিচ্ছে শাফিনের বন্ধু খোকনকে। তার সাহায্য ছাড়া এই সব কখনো করা যেত না। এমন এক অসভ্য কন্যা জন্ম দিয়ে ভুল যেমন করেছেন ঠিক তেমনি করে নিজের চোখের সামনে জবাই করে হত্যা করেছেন তাকে, তারপর সমস্ত শরীরটাকে শত খানেক টুকরো করে শাফিন কে ফাঁসিয়ে দেয়। এমন পুরুষ বেঁচে থাকার অধিকার নেই যে তার স্ত্রী কে অন্তত কি সঠিক কি ভুল সেটা শিখাতে ব্যর্থ।
ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করে সুহার্য।
-কি অবস্থা স্যার? গেইম তাহলে ভালোই খেলেছেন?
দলে দলে পুলিশ ঢুকতে থাকে ঘরে। বৃদ্ধ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
-কি করে তুমি বের করতে পারলে?
:আপনার চুল।
-আমার চুল..!
:হ্যাঁ,রকির হাতে কয়েকটা চুল ছিল। যার ডিএনএ টেষ্ট করার জন্য আমি ল্যাবে দিয়ে ছিলাম। আপনার ঘরেই আপনি সেটা আরও সহজ করে দিলেন। যখন আপনি সব শিকার করেন এবং মেয়ে নিয়ে আপনার নিজের উপর ঘৃণা। যতবার সামিয়া বা শাফিন নাম নিয়েছে আপনার মুখে একটা ঘৃনা ফুটে ওঠে।
আশা করি সব ক্লিয়ার?
-না!
আপনি যখন রকির সাথে ধস্তাধস্তি করছিলেন। তখন সে আপনার চুল ছিঁড়ে নেয়। যা তার হাতে ছিল। কিন্তু আপনি গাড়ি চালিয়ে ছিলেন তার যৌনাঙ্গের উপর দিয়ে। কিন্তু হাত চেক করেননি। সেটাই আপনার ভুল আর আপনি একজন সার্জন। সেটাও ভুলে যাবেন না, সেটা কি লুকাতে পেরেছেন? আমার ঈগল যখন আপনার ঘরে যায়, তখন সে সেটা আবিষ্কার করে। একটা ক্রেস, যেটায় লেখা ছিল ২০১০ সালের বেষ্ট সার্জন পুরষ্কার আমিন সাহেব।
আশা করি যথেষ্ট বুদ্ধিমান আপনি, আর বোঝাতে হবেনা আপনাকে।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আমিন সাহেব।
ঘরে ঢোকে শাফিন।
:তা তুমি রাত তিনটার সময় ওই জায়গায় হাঁটতে গিয়েছিলে কেন? এত রাত্রে তো মানুষ এই সব জায়গায় যায়না।
-আমার মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়,তখন হাঁটতে বের হই। তেমনি ভাবে আমিও হাঁটতে বের হয়েছিলাম।
:মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয়?
-হুম, মাঝে মাঝেই হয়।
:মাঝে মাঝে নাকি প্রায় সময়?
তীক্ষ্ণ ভাবে তাকায় তার দিকে সব থেকে বেষ্ট ইন্টারোগেশন করা মানুষটি। তার নাম সমস্ত শহরের পুলিশ ডির্পাটমেন্টের লোকদের মুখস্থ। যারাই এই পেশায় আসতে চায়,তারাই তাকে আইডল মনে করে। সুর্হায, আবার আগাগোড়া একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। কোথায় যেন সুর কেটে যাচ্ছে।
-জ্বী আপনি ঠিক বলেছেন,প্রায় সময়ই আমার মন খারাপ হয়। তাই রাত্রে বের হই।
:একলাই বের হন? নাকি সাথে আরও কেউ থাকে?
-না,আমি একলাই বের হই। মানুষের সঙ্গ আর ভালো লাগে না।
:আচ্ছা,আপনার বাসায় কে কে আছে?
-আমি,আমার স্ত্রী আর ওর বাবা।
:আপনার পক্ষের কেউ নেই?
-জ্বী না,আমি ওদের ওইখানে ঘর জামাই থাকি।
সুহার্য যেন এখন একটা তাল পাচ্ছে সুরে।তাল লয় সবই ফিরে আসছে।
:আচ্ছা,আপনার ঠিকানাটা লিখে যান। সামনে যদি এই কেসের জন্য কোনো দরকার হয় যোগাযোগ করবো।
-জ্বী আচ্ছা।
:ওহ, হ্যাঁ আপনার পেশা কি?
-আমি এক সময় সার্জন ছিলাম। এখন সব ছেড়ে ঘরে বসে থাকি আর স্ত্রীর কথা শুনি।
:হুম।বুঝতে পেরেছি আপনার কষ্ট।
-আমার ঠিকানা কি দিব? আপনারা প্রয়োজন হলে চলে আসবেন। শিল্পপতি আমিন সাহেবের বাড়িতে।
:ওহ হ্যাঁ,তাহলে তো হলোই।
বার বার "স্ত্রীর কথা শুনি" এই শব্দ গুলো মাথায় ঘুরছে সুহার্যের। তার তো আজকে বিবাহ বার্ষিকী। রিয়া পাই পাই করে বলে দিয়েছিল ৭ টার আগে বাসায় যেতে এখন বাজে রাত ১০টা। নিজেই নিজের কপাল চাপড়াতে মন চাচ্ছে। সমস্ত দেশের বড় বড় মাথা গুলো, আমার সামনে মাথা চাপড়ায় আর আমি একজন রিয়ার সামনে..! কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে,তাড়াতাড়ি গাড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। দেরী যখন হয়েই গেছে যাই শাহবাগের দিকে যাই,হয়তো একটু না হয় আরও দেরী হবে। যাই গিয়ে কিছু কিনে নিয়ে আসি।
বেশি সময় লাগে নি সুর্হাযের শাহবাগ পৌঁছাতে। পৌঁছেই যেই না ফুল কিনে গাড়িতে উঠবে। তখনই পেছন থেকে একজন শার্ট ধরে টেনে ধরে।
-আরে সুর্হায না তুই?
:হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?
-আমি কে মানে? হোয়াট দ্য ফাক ম্যান।তুই আমাকে ভুলে গেছিস?
কন্ঠ টা কেমন চেনা চেনা লাগছে। বাট মুখটা চেনা চেনা লাগছে না। ফিগার টা তো শাহিনার মতো লাগছে।
:শাহিনা? তুই এত রাত্রে এখানে কেন?
-যাক বাবা চিনেছিস তাহলে?
:হ্যাঁ চিনেছি। তুই আগে বল এত রাত্রে এখানে কি করছিস? সায়েম কোথায়?
-আরে ফাউল এত প্রশ্ন এক সাথে করলে হবে নাকি? আমি তো অপরাধী না,আমি তোর বন্ধু।
:ওহ, হ্যাঁ আমার তাড়া আছে রে। রিয়া খেপে আছে,আজকে আমাদের বিবাহবার্ষিকী কিন্তু কথা দিয়েছিলাম ৭ টায় ফিরবো আর এখনও আমি এখানে।
-হুম বুঝেছি, তোদের পুরুষদের এই সমস্যা। করবি ঠিকই নারীর কথা মতো সব বাট সেটা বকা খেয়ে বা চিপায় পরে, তার আগে না।
:আচ্ছা, তুইও চলনা বাসায়। এক সাথে সব করলাম। সায়েম কোথায়?
-ওই যে বিড়ি ফুঁকছে।
:শালারপুতের না বলে হুগের ভেতর সমস্যা আবার বিড়ি খেতে দিস কেন? যতসব।
-আরে ব্যাটা দিনে একটা বা দুটা খায় তাই কিছু বলিনা।আচ্ছা, দাঁড়া ওকে ডাকি।
:না থাক, তোমার যে পায়ের ক্ষমতা আর শরীর বানিয়েছ। রাত কেটে যাবে ওর কাছে যেতে আর এমন করে শত খানেক লেয়ার মারার কি দরকার? তুই কি এমনি কম সুন্দর? যতসব আজব পাবলিক।
-রেগে যাচ্ছিস কেন সুহার্য?
:রাগবো না তো কি করবো?
-বলতে বলতে হাঁটা ধরে,সায়েমের দিকে।
কানে ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসে।
রাত ১১ টা, নিকেতনে আমিন ভিলার সামনে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গেটের দাড়োয়ান তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়। তার শাফিনের শ্বশুর আমিন সাহেব যদিও বৃদ্ধ হয়ে গেছেন তবুও হাঁটা চলা করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা আছে।
-কি শাফিন কোথায় ছিলে এতদিন?
:জ্বী বাবা,আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম। এক বন্ধুর সাথে বইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। থিমটাও ন্যাচার নিয়ে তাই রাঙামাটি ঘুরেও আসলাম।
-কিন্তু এই দিকের খোঁজ তো রাখো একটু। সামিয়াকে গত দুদিন ধরে কোথাও পাচ্ছিনা।
:কি বলেন বাবা?
-হ্যাঁ, তোমাকে কতবার বললাম ফোন ব্যবহার করতে, না তা করো না। আমি বৃদ্ধ মানুষ কি করে খুঁজি? পরে ভাবলাম হয়তো তোমার সাথে গেছে। তাই পুলিশ কমপ্লেইনও করিনি।
:আমার তো মনে হয়, আপনার বন্ধুর ছেলের সাথেই আছে। এত প্যারা নিচ্ছেন কেন?এটা তো নতুন কিছু না।
-না, রকি মারা গেছে, সামিয়া যেদিন বাসা থেকে বের হয়, ওইদিন রাত্রেই।
:কি বলেন কি ভাবে?
-কারা যেন তার মুখ পাথর দিয়ে থেঁতলে দেয়। সাথে যত টাকা পয়সা ছিল সব নিয়ে গেছে।
:ইশ এমন করে মারা দরকারই ছিল না। মনে হয় পুরোনো শত্রুতা ধরেই খুন করেছে।
-হুম সেটা ধরেই পুলিশ তদন্ত করছে।
:আচ্ছা, তাহলে একটা পুলিশ কমপ্লেইন করে দিন। আমি খুব ক্লান্ত। গত কালকে পুলিশদের একটা লাশ খুঁজে দিয়েছিলাম। তার ফলে তারা একদিন আমাকে আটকে রাখে। আজকে ইন্টারোগেশন শেষ করে ছাড়ে। আমার গোসল করা দরকার। খেতে হবে কিছু।
এমন ব্যবহারের সাথে পরিচিত আমিন সাহেব। এটা নতুন কিছু না শাফিনের থেকে। হয়তো নিজের হাতে মানুষ মরতে-বাঁচতে দেখতে দেখতে শিখে গেছে কেমন করে নিজের নার্ভকে শীতল রাখতে হয়। তাছাড়া সামিয়া আর রকির কাজ কর্ম নিজের চোখে ধরার পর যেন শাফিন আরও বদলে যায়। নিজের ভালোবেসে বিয়ে করা স্ত্রীকে যখন অন্য কারোর সাথে নিজের বিছানায়ই আবিষ্কার করে, তখন সেই পুরুষের কেমন লাগবে তা অজানা নয় কারোর।সাত বছর প্রেম তারপর বিয়ে করে। পাঁচ বছর পর সামিয়া এমন ভাবে ধরা পরে শাফিনের হাতে। হয়তো সেই ধাক্কাই তাকে বদলে দিয়েছে।
চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে ফিরে আসে অফিসে সুর্হায। আলী, তাকে দেখেই হেসে উঠে।
-কি স্যার গত রাত্রেও কি দরজার বাইরে কাটিয়েছেন?
:সাথে সাথে মনে পরে যায়,গত কালকে কি করেছিল রিয়া ওর সাথে। সায়েম আর শাহেনারে নিয়ে মজা করেছিল আর তাকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সারা রাত। সকালে দরজা খুলে নতুন শার্ট আর একটা টাই গিফট করে আর বলে আজকেও যেন বাসায় না ফিরি। যদি ঘরের সামনে দেখেছে তবে সুহার্যের খবর আছে। এমন ভাবেই শুরু হয় দিন। কি যে যন্ত্রনা, এক তো প্রেম করে বিয়ে আবার সাংবাদিক বৌ। কার না কপালে শনি থাকবে?
-আমাদের হাতে নতুন একটা কেস এসেছে। এখন আপনার ইন্টারোগেশন থেকেও মাথা খেলাতে হবে বেশি। আর দ্রুত সমাধানও করতে হবে। কেসটা শিল্পপতির একমাত্র মেয়ে সামিয়া গত তিন দিন ধরে নিখোঁজ।
উপরের মহল থেকেই আসছে কেসটা, যদিও নরমাল কমপ্লেইন তবুও জানিনা উপরে থেকে ওনারা কেন ওনাকে খুশি করতে এত দৌড়াচ্ছেন।
:হুম,শিল্পপতি বলে কথা। দুদিন পর নির্বাচন। খুশি করতে পারলেই তো হল। তা এখন কি আমার আবার গোয়েন্দা হতে হবে নাকি?
সবাই হেসে উঠে এবং এক বাক্যেই বলে উঠে, "জ্বী স্যার"।
:আচ্ছা ঠিক আছে, ঈগল আসো আমার সাথে আর পিএস তুমি মেয়েটার সম্পুর্ণ প্রোফাইল তৈরী করো। বাকিরা গতদিনের ওই অজ্ঞাতনামা কেসটার উপর নজর রাখো।
-জ্বী স্যার।
আমিন সাহেবের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুহার্য বলে উঠে,
-এই ওর স্বামী না শাফিন? ওই যে লোকটাকে কালকে ইন্টারোগেশন করলাম?
:জ্বী স্যার। এটাই সেটা, বলে ওঠে ঈগল।
-নজর ঠিক মতো রেখো। আমার সব কিছুই কেমন এলোমেলো লাগছে।
:ঠিক আছে স্যার।
-পারলে ওদের দুজনেরই চুল কালেক্ট করে নিও তো।
:অবাক হয়ে তাকায় ঈগল। তারপর কয়েক ন্যানো সেকেন্ড পরই বুঝতে পারে কি বোঝাতে চেয়েছে সুহার্য ।
বাড়ির তো নয় যেন রাজপ্রসাদ। নাস্তার টেবিলে নাস্তা ভর্তি। দুজন মানুষ কিন্তু কর্মচারীর অভাব নাই।
এখন যেন নতুন করে শাফিনকে দেখতে পায়। একবারেই ভিন্ন একজন মানুষ। সুদর্শন বললেও কম হয়ে যাবে। সামনে বসে আছে বৃদ্ধ আমিন সাহেব।
-আমার কিছু প্রশ্ন আছে আপনাদের কাছে। আশা করি সব ঠিকঠাক জবাব দিবেন।
দুজনই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
ঈগল হাঁটতে হাঁটতে ভেতরের রুম গুলো চেক করে। যেন বোঝাতে চাচ্ছে বাড়িটা দেখে সে অবাক। তাই আরও সুন্দর করে দেখতে চায়।
-বিশেষ করে শাফিন সাহব,আপনি কোথায় ছিলেন যখন আপনার স্ত্রী বাইরে যায়?
:আমি তারও আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই, প্রায় আপনার সাথে দেখা হবার ৭ দিন আগে।
-কে ছিল আপনার সাথে?
:আমার সাথে কেউ থাকে না,আমি একলাই ঘোরাঘুরি করি। কিন্তু এইবার চিটাং এর একজন বন্ধু ছিল। মিশু, সে আমার সাথে রাঙামাটিতে গিয়েছিল। সেই তার গাড়িতে করে আমাকে নামিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। তাই ওই পার্কের দিকে ঘুরতে যাই। তারপর ওই লাশটা আবিষ্কার করি এবং আপনাকে জানাই।
-হুম,ঠিক আছে।তা আপনার কি মনে হয় কোথায় যেতে পারে?
:আমার জানা মতে তার রকির সাথে যাবার কথা। কিন্তু রকি যেহেতু মারা গেছে,যেদিন রাত্রে সে বাড়ি থেকে যায় তারপর দিন সকালেই রকির নাকি লাশ পাওয়া যায় আমার শ্বশুর বললেন। তাহলে বাকিটুকু আমি জানি না।
-রকি মানে? ওই যে গাড়ি চাপা পড়ে খুব বিশ্রী ভাবে মারা যায় সে?
:হুম।
-আপনার কি ধারণা আমিন সাহবে?
:আমিও একমত শাফিনের সাথে। তবে কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছে কুকুর কামড়ালে কুকুর কে কামড়ানোর অভ্যাস থেকে যায় গরীব ঘরের ছেলেদের। এরা বুঝতে চায়না, কুকুরের কাজই কামড়ানো, আমাদের কাজ এন্টিবায়োটিক নেওয়া।
-বুঝলাম না সঠিক।
শাফিনের গাল, চোখ, মুখ লাল হয় উঠে।
তখনই সুহার্য বুঝতে পারে,শ্বশুর কাকে সন্দেহ করছে। সহজ কিছু পয়েন্ট হাতে চলে আসছে। মেয়েটার পরকিয়া ছিল রকির সাথে,তার মানে রকি এক্সিডেন্টে মারা যায়নি। এটা খুন ছিল,আমার সন্দেহই সঠিক।
ধন্যবাদ,আমরা চেষ্টা করব আমাদের সর্বোত্তম টা দিয়ে। বাকিটা আল্লাহর হাতে।
আমিন সাহেব বলে ওঠেন, "জ্বী তাই করেন পুলিশ সাহবে"।
কর্মোদ্ধার করে নিচে নেমে আসে ঈগল আর সুহার্য।
-কি হল সব?
:জ্বী,চুল বের করতে পেরেছি।
-ঠিক আছে ল্যাবে পাঠিয়ে দাও।
অফিসে ফিরে আসতেই দেখতে পায় ডেস্কে একটা টিফিন বক্স। সবাই মুচকি হাসছে তার মানে রিয়া এসেছে এখানে। টিফিন বক্সের নিচে ছোট একটা চিরকুট-
" আমাকে ভালোবাসছো আবার অবহেলা দিবে!
সেটার দুঃখ ভোগ করবে না তা হয়? আর দেরী করলে দু দিন ঘরের দরজায় পা রাখতে দিব না। ঠিক মতো খেয়ে নিও,আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে আজকে মনে থাকে যেন। "
খাবার টুকু খেয়ে বের হয়ে আসে নিজের ছোট রুমটা থেকে।
-কি হল পিএস? সব রেডি?
:জ্বী স্যার।
-তো বলো কি কি করলে?
:মেয়েটার একটা বড় ফটো পর্দায় ভেসে ওঠে।
তারপর সব কিছু বলতে শুরু করে।
মেয়েটা একটা নাম করা কলেজের প্রফেসর ছিল। তার এবং শাফিনের ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু হুট করে গত এক বছর ধরে তাদের সম্পর্কের মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় রকি নামের ছেলেটা। সে শিল্পপতি রায়হান খানের ছেলে,সামিয়া আর রকির ভেতর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল আগে থেকেই। কিন্তু যখন শাফিন লেখা লেখি করার জন্য সার্জনের পদ ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে শুরু করে, তখনই সামিয়া রকির দিকে ঝুঁকে যায়। কিন্তু সেটা শুধু ঝোঁকাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। বলা যায় নোংরা। আমরা কাজের লোকদের থেকে যা জানতে পেরেছি তা খুবই ভয়ংকর। শাফিনের বাচ্চা ছিল সামিয়ার গর্ভে কিন্তু রকির জন্য সে সেটাকে পৃথিবীর মুখ দেখতে দেয়নি । এবরশন করে শাফিন কে জানায় সে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ায় বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়। তারপর সামিয়া ও রকি কয়েকবারই হাতে নাতে তাদের বিছানায় ধরা পরে শাফিনের কাছে। কিন্ত শাফিন কেন তাকে ছাড়েনি বা কেন দূরে যায়নি আমরা জানি না। তবে সামিয়ার নোংরামী এত বেশি ছিল বা এত ফ্যান্টাসিতে ছিল যে, ঘরে একজন বৃদ্ধ আছে বা তার বাবা আছে সেটাও ভুলে যেত।
যার ফল হঠাৎ সে হারিয়ে যায়।
-অনেক বেশি করেছ তোমরা আজকে,এই জন্যই আমরা আজও বাংলাদেশের প্রথম গোয়েন্দা যারা কখনো কোনো কেস হারিনি।
চলো কাজ চালিয়ে যাও,আমি বাইরে যাই।
রাত প্রায় তিনটা, রিয়া ঘুমিয়ে আছে। সুহার্য এর ঘুম আসছে না। মাথায় কয়েকটা শব্দ ঘুরছে। মেকআপ করা শাহিনার মুখ আর সার্জন শাফিন আর তার শ্বশুরের বলা কথাটা। একটা জিনিস সত্যি, কুকুর যখন বাচ্চাদের কামড়াতে আসে তখন তারা কামড়াতে যাবেই। গরীব বলতে শাফিন কে বুঝিয়েছে। কিন্তু বার বার সার্জন আর মেকআপ কেন মাথায় ঘুরছে?
হঠাৎ ডিম লাইটের আলোতে রিয়ার মুখটার দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে উঠে। রিয়া কৃত্তিম একটা তিল দেয় তার নাকের বাম সাইডে যেটা সুহার্যের খুব প্রিয়। তখনই একটু হলেও পরিবর্তন লাগে তাকে।
তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নেয়।
দুবার রিং হবার পর কলটা রিসিভ হয়।
-হ্যালো সার্জন?
:জ্বী স্যার।
-তাড়াতাড়ি তুমি সামিয়ার ময়নাতদন্তের রুমে যাও।
:সামিয়া মানে কি বলতে চাচ্ছেন স্যার?
-আরে ধুর,অজ্ঞাতনামা লাশটার কাছে যাও। গিয়ে তার মুখের চামড়াটা টেষ্ট করে দেখো তো। সেটা কি সার্জারি করে লাগানো নাকি আসল। দ্রুত যাও।
:আমাকে একটু ঘুমাতেও দিবেন না?
-দিব,আগে কাজটা করো। তারপর দুদিনের ছুটি।
:সত্যি?
-হুম সত্যি।
রিয়া সুহার্যের গলার স্বর শুনে ঘুম থেকে উঠে বসে। ব্রা টা ঝুলে আছে বুকে।হাল্কা আলোয় যেন আরও অপরুপ লাগছে তাকে। রিয়ার দিকে সুর্হাযের তাকানো দেখে তাড়াতাড়ি বুক ঢেকে বসে।
-ভুলেও না।
:একটু প্লীজ
-না বলেছি, ঠিক মামলা করে দিব আর একটু এগোলে।
:এমন করো কেন?একটু প্লীজ।
-দূর হ খাটাস, সামনে আসবি না। ভূত চেপেছে এই শেষ রাত্রে।
মুখ কালো করে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে পরে সুহার্য।রিয়া পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে।
সকাল না হতেই গাড়ি নিয়ে হাজির হয়ে যায় অফিসে সুহার্য। ফাইল একটা হাতে ফিরে আসে সার্জন। তাদের টিমেরই সব, একই টিমে সব সদস্য ভর্তি, এরা যেমন গুলি চালাতে পারে তেমনি পারে ডিপ নাইফ ১৫ ও চালাতে।
-জ্বী স্যার আপনিই রাইট। তাকে প্লাষ্টিক সার্জারি করা হয়েছে। যার কারনে শুধু মুখমণ্ডল টা ঠিক রেখে শরীরের সমস্ত অঙ্গ গুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে সাজিয়ে রাখে।
কেসটা সমাধান হয়ে গেল দুদিনে।
দুজনই হেসে উঠে।
-ঠিক আছে,তাহলে শাফিনকে এরেষ্ট করো। দুটি খুনের আসামী হিসেবে।
আর লাশটি সামিয়ার নামে তার বাড়িতে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করো।
সমস্ত টিভি চ্যানেল গুলোতে একটাই নিউজ। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন। রসিয়ে রসিয়ে খবর পড়ছেন নিউজ প্রেজেন্টাররা।
আমিন সাহেব মুচকি হাসছেন আর একটা মদের পাত্র থেকে মদ ঢেলে দিচ্ছে শাফিনের বন্ধু খোকনকে। তার সাহায্য ছাড়া এই সব কখনো করা যেত না। এমন এক অসভ্য কন্যা জন্ম দিয়ে ভুল যেমন করেছেন ঠিক তেমনি করে নিজের চোখের সামনে জবাই করে হত্যা করেছেন তাকে, তারপর সমস্ত শরীরটাকে শত খানেক টুকরো করে শাফিন কে ফাঁসিয়ে দেয়। এমন পুরুষ বেঁচে থাকার অধিকার নেই যে তার স্ত্রী কে অন্তত কি সঠিক কি ভুল সেটা শিখাতে ব্যর্থ।
ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করে সুহার্য।
-কি অবস্থা স্যার? গেইম তাহলে ভালোই খেলেছেন?
দলে দলে পুলিশ ঢুকতে থাকে ঘরে। বৃদ্ধ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
-কি করে তুমি বের করতে পারলে?
:আপনার চুল।
-আমার চুল..!
:হ্যাঁ,রকির হাতে কয়েকটা চুল ছিল। যার ডিএনএ টেষ্ট করার জন্য আমি ল্যাবে দিয়ে ছিলাম। আপনার ঘরেই আপনি সেটা আরও সহজ করে দিলেন। যখন আপনি সব শিকার করেন এবং মেয়ে নিয়ে আপনার নিজের উপর ঘৃণা। যতবার সামিয়া বা শাফিন নাম নিয়েছে আপনার মুখে একটা ঘৃনা ফুটে ওঠে।
আশা করি সব ক্লিয়ার?
-না!
আপনি যখন রকির সাথে ধস্তাধস্তি করছিলেন। তখন সে আপনার চুল ছিঁড়ে নেয়। যা তার হাতে ছিল। কিন্তু আপনি গাড়ি চালিয়ে ছিলেন তার যৌনাঙ্গের উপর দিয়ে। কিন্তু হাত চেক করেননি। সেটাই আপনার ভুল আর আপনি একজন সার্জন। সেটাও ভুলে যাবেন না, সেটা কি লুকাতে পেরেছেন? আমার ঈগল যখন আপনার ঘরে যায়, তখন সে সেটা আবিষ্কার করে। একটা ক্রেস, যেটায় লেখা ছিল ২০১০ সালের বেষ্ট সার্জন পুরষ্কার আমিন সাহেব।
আশা করি যথেষ্ট বুদ্ধিমান আপনি, আর বোঝাতে হবেনা আপনাকে।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আমিন সাহেব।
ঘরে ঢোকে শাফিন।
-রেজাউল করিম
0 Comments