গল্প: ঠিকানা

ঠিকানা





আজহার মোটামোটি একজন ভালো লেখক তবে তার এই লেখাতে কিছু বিষয় খুব বাজেও থাকে। যেমন নির্দিষ্ট একটা গোষ্ঠীকে খুশি করানো! 
তার থেকে বড় কথা আজহার নিজেকে একটা উচ্চতায় বসিয়ে নিয়েছে। সে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, সে আসলেই একজন লেখক। যে সমাজের জন্য লেখে,মানবতার গান গায় অথবা অনেক নারীই তাকে কামনা করে।
যার কারণে,সে বার বার প্রিয়ন্তীর ফুটন্ত গোলাপের পাপড়িগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিতে এক সেকেন্ডও ভাবে না।
প্রিয়ন্তী এবং আজহার দুজনই, একই ডির্পাটমেন্ট এর স্টুডেন্ট। একটা সময় দুজন দুজনকে ছাড়া চলতো না ,আজকাল প্রিয়ন্তীর সময় হয় আগের মতোই। সূর্যোদয় হয় আবার ডুবেও যায়। ভোরের কুয়াশায় ঘাসের ডগা ভিজবে এটাই শীতের নিয়ম। যদি না কৃত্রিমতা প্রকৃতিকে গ্রাস করে নেয়। পথ হারা পাখিরাও ঘরে ফেরে, তবুও আজহারের আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তায় যেন প্রিয়ন্তীর নাম ডুবন্ত এক যুদ্ধ। 

অনেক তো হল, প্রিয়ন্তীরও বিয়ের বয়স হয়ে গেল। তাই আর সময় নষ্ট না করে পরিষ্কার হয়েই যেতে চায়। তাই আজহারের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলা উচিৎ।

যখন সে স্টার না,তখনও একান্ত সব প্রিয়ন্তী,সব কবিতার নারীই প্রিয়ন্তী আবার সেটার উপাসনাও তারই ছিল। আজ শুধু সৃষ্টির সাথে কথা হয়, যার সন্তান এই কবিতার বই তার সাথেই কথা হয়না প্রিয়ন্তীর।

আজ আজহারের একটা নতুন কবিতার বইয়ের প্রকাশ ডেট। তাই মোটামোটি সে ভালো আনন্দে থাকবে।
সব শেষে প্রিয়ন্তী কথাটা বলবে ভেবেই এগিয়ে যাচ্ছে।

সব শেষে আবার দুজন একা হাঁটা ধরেছে বিশাল ক্যাম্পাসের মাঠ ধরে। প্রিয়ন্তী নিজের থেকে বলে উঠে,

:: আজহার,আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা...
কথাটা শেষ করার আগেই, আজহার বলে ওঠে,
:: আমাদের সম্পর্ক মানে? আমরা তো শুধু মাত্র বন্ধু,এখানে বাকি কি সম্পর্ক?
:: আমি বলতে চাচ্ছি,আমি তোকে ভালোবাসি। আর সেটাই গত ৫ বছর ধরে ভেবে আসছি।
:: ভেবে আসছিস মানে কি? আমরা কি এমন কোনো কথায় কখনো গিয়েছি? এমন কথা তো কখনো ছিল না।
:: হুম ছিল না,কিন্তু তখনকার চোখে আমি দেখেছি। আজকেরও চোখেও আমি দেখি। তোর পার্থক্যটা দেখেই ভয়ে ছিলাম। তাই ক্লিয়ার হতে বললাম। যাক বাবা ভালো হলো কোনো সমস্যা বা দ্বিধা নিয়ে সংসারে বসতে হবে না।

বলেই আজহারের অগোচরে চোখের পানিটা মুছে নেয় প্রিয়ন্তী।

:: হুম, সেটাই।
:: তবে যাই বলিস,একটা সময়।এই ভরা দুপুরে রিক্সায় অথবা তোর বাসের ঘামে ভর্তি শরীরের গন্ধটাও নাকি তোর কবিতার খোড়াক হতো। আবার আমার ঠোঁটে তোর নাকি উষ্ণতা হতো। কি বিশাল একটা সময়।
তোর চোখ দেখেই বিশ্বাসের পাহাড় গড়েছিলাম। পতিতার মতো সমস্ত কিছু দিয়েছি বিক্রি করে ।শুধু তোর ঐ দুটা চোখের দামে।আজ শুনি সে চোখ দুটাও নাকি মিথ্যা বলে...!
:: এইসব কি বলিস প্রিয়ন্তী?
হাতটা ধরে ঘাসের উপর বসে পড়ে দুজন ।এক প্রকার জোড় করেই বসায় প্রিয়ন্তীকে আজহার।

এমন সময় ভার্সিটির জুনিয়ার একটা গ্রুপ এসে,আজহার থেকে অটোগ্রাফ নিয়ে যায়। আজহারও হাসতে হাসতে তাদের বিদায় করে। প্রিয়ন্তী বিশাল মাঠের শেষ প্রান্তের দিকে তাকিয়ে আছে ।

:: আমি কি বলি তুই কি জানিস না? নাকি সব শুনেও না শোনার মতো আছিস?
:: সেটা একান্তই আমাদের বন্ধুত্বের ...
:: দেখ আজহার, পৃথিবীতে কোনো নারীই তার চারপাশের পুরুষের চোখ দেখে অন্ধ হয়ে বসে থাকে না। তাদের চোখ তোদের মতো পুরুষের কল্পনার থেকেও বেশি দ্রুত চলে ,তারা ধরতে পারে কখন পুরুষটা তাদের প্রেমে পড়েছে।
:: হুম,সেটা মিথ্যা বলিসনি।তাই বলে..
:: আমি জানি,আজ তুই অনেক বড় লেখক। কিন্তু যাদের জন্য লিখিস। যা লিখিস।তুই আজও স্রষ্টা হতে পারিসনি। হয়েছিস গোলাম। যারা তোর চারপাশে তোর কবিতার গল্প বলে,তাদের বলিস একটা লাইন ভেঙ্গে তোকে বুঝিয়ে দিতে..! 
আজও তুই লিঙ্গভেদ করিস। যেদিস স্রষ্টা হবি,সেদিন ঐসব গোষ্ঠীকে খুশি করতে লিখবিনা। লিখবি ন্যায় অন্যায়,কোনো পুরুষ অথবা নারীর পক্ষে নয়। তখন লিখবি তোর দুচোখের বিচারে..! 
লেখক হতে পারে সবাই,স্রষ্টা হতে পারে কয় জন? 
যারা সৃষ্টি করে নিজেরই বিচারে নিজেরই একটা পথ, যেখানে সবার জন্য সমান অধিকার ।
একজন নারী গোষ্ঠীকে খুশি করে তার উষ্ণতা পাওয়া অথবা শুধু নারীর গান গেয়ে নারীর উষ্ণতা পেলে যদি লেখক হওয়া যেত তাহলে তো তুই পৃথিবীর প্রথম লেখক হতি ...
কথা গুলা বলে চুপ করে উঠে তাড়াতাড়ি মাঠটা পেড়িয়ে চলে যায় প্রিয়ন্তী।

আজহার চুপ করে থাকে,সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে।সাথে মনের ভেতরের সব গ্লানিবোধ জেগে উঠেছে। আসলেই তো ন্যায় অন্যায় কিছু বুঝিনি। সমস্ত নারীর পক্ষেই লিখেছি,তাই আজ নারী পাঠকের অভাব নেই ।কিন্তু সেখানে আমার সৃষ্টি কতটা বিকাশ পেয়েছে? নাকি আমি সামান্য নারীর নতুনত্বের উষ্ণতা পাওয়ার জন্য নিজেকে চুপ করিয়ে নিয়েছি?

সূর্য ডুবছে।এক অচেনা পথিক চেনা পথে ফিরে যাচ্ছে,যেন বহু বছর পর, ঘরে না ফেরা পথিক ঠিকানা চিনেছে।

-রেজাউল করিম

Post a Comment

0 Comments