বই পর্যালোচনা
বইয়ের নাম: পদ্মার পলিদ্বীপ
লেখক:আবু ইসহাক
ঘরানা: অপরাধমূলক রোমাঞ্চ/ সামাজিক উপন্যাস
প্রকাশনী : নওরোজ সাহিত্য সম্ভার
প্রকাশকাল: ১৯৮৬
পৃষ্ঠা:২২৪ টি
মূল্য:৩০০
এমন এক উপন্যাস,যেখানে কোনো দুর্বল চরিত্র নেই কিন্তু খুব সবল চরিত্র গুলোই আপনার ভেতর একটা আবেগের ঘনছায়া তৈরি করবে।জরিনা এমন এক চরিত্র, যে নিজ সত্তার ডাকে ভালোবাসা সাড়া দেয়। যদিও সেটা চরিত্রহীনতা তবুও লেখক বোঝাতে পেরেছেন, ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর কিছুই নেই, যা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রুপজান এক বন্দী দেবী। সমস্ত বই জুড়েই যাকে পাবার জন্য সমস্ত কিছু হয়ে উঠে চরের সাথে। যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চর এবং রূপজান কে নিয়ে হচ্ছে।
মাতবর এরফান এবং মোল্লা এরশাদ এই দুজনের শক্তপোক্ত চরিত্র বাংলা সাহিত্যের একটা বাস্তব বাঙালী চিত্র।
ফজর আর পা-না -ধোয়া জাঙ্গুরুল্লা নায়ক এবং ভিলেন। জাঙ্গুরুল যেমন বুদ্ধিতে তুখোর তেমনি শক্তিতে এক অপরিসীম ভয়ংকর। ফজল যেমন শিক্ষিত, তেমনি দাবার গুটির চাল দিতে পারে, ভাগ্যের সুন্দর এক ইঞ্চি সরে গেলে।
এই তো গেল আসল উপাদান, বইটাতে কি নেই? ব্রিটিশ বিরোদী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চিত্র, ধর্মের ব্যবসা, প্রেম,সমাজ ব্যবস্থা এবং রাজনীতি আরও অনেক কিছু।
যারা আবু ইসহাকের "সূর্যদীঘল বাড়ি " পড়ে বলেছেন উনি সেরা,তারাই আবার এই বই পড়ে বলবেন এই লোক সবার সেরা। কিন্তু আমি সেটা বলছিনা।পাঠকদের কাজই এটা,যখন যে বইয়ের প্রেমে পড়ে তখন সেটাই সেরা।
আমার কাছে আজ পযর্ন্ত যেমন
ক্লাইভ কাসলারের "দ্য চেজ" বইটি বেষ্ট তেমনি আবু ইসহাকের
" পদ্মার পলিদ্বীপ " বইটি তাঁর সেরা বই। "দ্য চেজ" শেষ করি ১মাস ধরে পড়ে আর এই বই শেষ করি এক দিনে। চেজ বইটিতে " বুচার ব্যান্ডিট" আমার প্রিয় চরিত্র ছিল। তাড়াতাড়ি শেষ করলে চরিত্রটিকে মেরে ফেলা হবে মনে করে ধীরে ধীরে পড়েছিলাম।
আবু ইসহাকের এই বইটি পড়ার সময় মাথায় ছিল দুটা জিনিস। ফজল বেঁচে থাকবে তো? রুপজান থেকেও বেশি চিন্তা করেছিলাম জরিনাকে নিয়ে। কিন্তু কষ্ট দিলো লেখক, জরিনার চরিত্রটি দিয়ে।
বিষয়বস্তু:
পদ্মার ভাঙ্গনে ভেঙ্গে গেছে চর,নতুন করে জেগে উঠছে নতুন চর। যার নাম খুনের চর,দশ বছর আগে এই চরে পাঁচজন খুন হয় চর দখল নিয়ে। সেখানে ছিল মাতবর এরফানের ছেলে রশিদও। বর্তমানে এই খুনে চর দখল করতে কেউ আসবে না, জানে মাতবর তবুও সে কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চায়না। তাই অস্ত্র নিয়ে রেডি থাকে তাদের চর তাদের দখলে রাখতে।
ফজল মাতবের শেষ সন্তান, তার বিবি আছে বাপের বাড়িতে। মাতবরের জন্য রূপজানকে স্বামীর বাড়িতে আসতে দেয়না,কিন্তু ফজল এবং রুপজানের প্রেম ঠিকই আছে।
অন্য দিক দিয়ে বিশাল শত্রু একজন জেগে উঠেছে। কারোর সেটা মাথায় নেই। যেকোনো সময় হামলা পড়তে পারে খুনের চড়ের উপর।
জরিনা এক প্রেমিকা,যার কম বয়সে বিয়ে হয়। যখন সরকার বাল্যবিবাহ বন্ধের ঘোষণা দেয়। তখন ঘোষনা কার্যকর হবার আগেই সবাই বিবাহ সম্পাদন করে। এই বিবাহের ভেতরই হয়ে যায় জরিনা এবং ফজরের বিবাহ কিন্তু ভেঙ্গে যায় বিবাহ যখন ১৫ বছর হয় জরিনার।
উপরের চারটি ঘটনার মিলন মেলা নিয়ে লেখা আবু ইসহাকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'পদ্মার পলিদ্বীপ'। এই চারটি গল্পের আগের এবং পরের ঘটনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবেন পাঠক। যেমন আছে ভালোবাসা তেমনি আছে আলাদা আলাদা দৃষ্টি । এক অপরুপ বই এটি।
আপনি কেন পড়বেন?
বাংলা সাহিত্য জানতে হলে এটা পড়া উচিৎ,কলকাতার দাদারাই যে আমাদের বাঙালী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে রেখেছেন আর যে ছায়ায় নিজেদের ভুলে যাচ্ছি সেটা থেকে বের হবার জন্য এর থেকে ভালো উপন্যাস হয় না। এক মহাকাব্য বলা যায় একে, যা চর জীবন এবং ধর্মীয় অন্ধত্ব নিয়ে লেখা।
আমার কথা,
বইটিতে যেমন শক্তপোক্ত শক্র তেমনি চালাক একজন নায়ক। যেমন আছে ধৈর্য্য এবং বাস্তবতা মেনে নিয়ে পথ চলার কথা তেমনি আছে নিজের সত্তার কাছে হেরে যাওয়ার এক অপরুপ ধ্বংসাত্মক চরিত্র। যেমন কর্ম তেমনি ফলে বিশ্বাসী আমাদের লেখক। যাকে যতটা সময় এবং যতটা শক্তি দেওয়া যায় তার কমও দেননি আবার বেশিওনা।
যুদ্ধের দৃশ্যপট টা ছিল অসাধারন। এমন লেখাই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, করেছে আমাদের মুসলিম বাঙালী( এটা একটা টার্ম বাংলা সাহিত্যে,এক সময় বাঙালী সাহিত্য মানে হিন্দু সাহিত্য ধরা হতো। যেখানে মুসলিমরা ছিল মূর্খ) লেখকদের অপ্রতিরোধ্য।
রেটিং দেওয়ার মতো আমি কেউ না। তবুও আমি এই বইটিকে ১০/১০ দিব।
ধন্যবাদ।
0 Comments