লেখক জীবনী -১
আবু ইসহাক এবং একজন ধর্মীয় আলো!
আবু ইসহাক একজন বাংলাদেশের লেখক,যিনি কিনা আমার মতে একজন স্মার্ট, রুচিশীল এবং শক্তপোক্ত স্পষ্ট ধারণার অধিকারী। আমি নতুন মানুষ,যে বাংলাদেশের লেখকদের বই পড়বো বলে নিয়ত করে পড়া শুরু করি। এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করি,আমাদের সম্পত্তি অঢেল কিন্তু এর পরিচর্যাকারী নেই। তাই আমিই শুরু করেছি।
"একজন দেশি লেখক শেষ করে যেকোনো আন্তর্জাতিক লেখা পড়বো একটা "
সাহিত্যের কোনো সীমান্ত নেই,কিন্তু নিজের দেশের লেখকদের প্রচার করা এবং অনুপ্রাণীত করাও নিজেদের কর্তব্য। আপনি নিজেদের দেশের বই না পড়েই ট্যাগ দিলেন " বাঙালী লেখক মানেই নাক উচুঁ শুধু ভারতীয় বাঙালী লেখকদের"
মাঝখানে আমাদের লেখক মানে ঘরের সন্তানরা হারিয়ে যাচ্ছে! যেখানে ১০০% এ ১০০% পাঠক রবীন্দ্রনাথদের চিনছে, সেখানে আমার নিজের ঘরের আবু ইসহাক এবং আহমদ ছফার মতো মানুষদের চেনে না! অদ্ভূত না?
" যারা ভালো লেখে তাদের তো চিনবেই"
হাহাহা তো ভাই কয়জন ইংরেজি লেখকের নাম বলেন তো?
" না মানে, আমরা তো....... "
সাহিত্য জগৎটা কি শুধু দাদাদের কাছেই সীমাবদ্ধ? না,তাহলে দাদাদের পড়েন কেন? কারণ ভাষাটা বাংলা আর আমরা যারা নিজেরাই এই ভাষার মালিক তারাই হচ্ছি অবহেলিত। বাহ বাহ বাহ জাতীয় সত্তা।
" ভারতীয় বাঙালীর যত অবদান তত অবদান তো বাংলাদেশের লেখকদের নাই"
থাকবে কেমন করে? লেখকদেরই তো চেনেন না।চিনলে তো বলতেন হ্যাঁ অবদান আছে। পড়লে তো বুঝতেন এরা কোন ধরনের লেখক। বাংলাদেশের জন্মের পর এবং আগে সব টেনে দেখুন এই সময় আমরা কতটা করেছি আর দাদারা ৫-৮ শ বছরে কি করেছেন?
যাই হোক,আমার মেইন থিম হল, নিজের দেশের লেখক/অনুবাদক এর বই। এই স্লোগান নিয়েই দেশীয় লেখকের বই পড়া শুরু করেছি এবং লেখকদের পরিচয় হাল্কা করে লেখার চেষ্টা ।
জন্ম- ১৯২৬, নভেম্বর ১
(বাংলা ১৫ কার্তিক ১৩৩৩)
বর্তমান শরিয়াতপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
জাতীয়তা: বাংলাদেশি
নাগরিকত্ব : বাংলাদেশ
পরিচিতি: লেখক
মৃত্যু: ২০০৩,ফেব্রুয়ারি ১৬
ব্যক্তিগত জীবন:-
আবু ইসহাক একজন বাংলাদেশী কথাসাহিত্যক। তিনি জন্ম গ্রহন করেন ১৯২৬ সালে এবং ১৯৪২ সালে মাধ্যমিক, ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৬০ সালে করাচি থেকে বি.এ পাশ করেন।
তাঁর বাবা মোহাম্মদ এবাদুল্লা এবং মাতা আতাহারুন্নিসা।
১৯৫৯ সালে তিনি পুলিশের বিভাগে সহকারী পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন। তারপর ১৯৫৬ সালে করাচিতেও এই পদে আসীন ছিলেন।
১৯৭৩ সালে দেশে ফেরেন এবং গোয়েন্দা সংস্থার উপ পরিচালক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনার এর প্রথম সেক্রেটারি পদ লাভ করেন। তারপর আবার গোয়েন্দা পদে ফিরে আসেন এবং ১৯৮৪ সালে অবসরে যান।
গ্রন্থসমূহ:-
তাঁর প্রথম উপন্যাস ছিল, 'সূর্যদীঘল বাড়ি',
"ভাতের লড়াইয়ে হেরে যায় তারা। অতীতের কান্না চেপে, চোখের জল মুছে তারা আসে, কিন্তু মানুষের চেহারা নিয়ে নয়। শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে, পেট গিয়ে মিশেছে পিঠের সাথে। ... তবুও তারা ভাঙা মেরুদণ্ড নিয়ে সমাজ ও সভ্যতার মেরুদণ্ড সোজা করে ধরবার চেষ্টা করে। ...পঞ্চাশের মন্বন্তরে হোঁচট খাওয়া দেশ আবার টলতে টলতে দাঁড়ায় লাঠি ভর দিয়ে।"
সূর্যদীঘল বাড়ি এমন একটা ভিটে মাটির বাড়ি যেটাকে বলা হয় অভিশপ্ত বাড়ি। পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত বাড়ি তাই একে সূর্যদীঘল বাড়ি বলা হয়। এই বাড়ি যদিও গ্রামে আরও দু একটা আছে, কিন্তু সে বাড়িতে কেউ থাকে না। এই রকম বাড়িতে থাকলে বংশ টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু জয়গুন আর তার ভাইয়ের স্ত্রী শফির মা ফিরে এসেছে তাদের পুরোনো ভিটাতে। জয়গুনের প্রথম স্বামী ছিল খুব জব্বার মুন্সি এবং ভালো একজন মানুষ। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার আগে তার স্ত্রী জয়গুনকে এবং এক সন্তান হাসু কে দিয়ে যান করিম বক্সের কাছে। যার সাথে বিয়ে হওয়ার পর হয় মায়মুন নামের একটা মেয়ে এবং কাসু। ৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময় কাসুকে রেখে মায়মুন এবং হাসু সহ জয়গুন কে তাড়িয়ে দেয় করিম বক্ম। না পারে নিজের ভিটা মাটির বাড়িতে ফিরতে না পারে গ্রামে থাকতে। শহরে ছু্টে যায় জীবনের তাগিদে। ব্যর্থতার জীবন শেষ করতে আবার গ্রামে ফিরে আসে জয়গুন।
এই ভাবেই গল্পটি শুরু হয়। যা শেষ হয় ডার্ক একটা অনুভূতি দিয়ে। তিনি এক সাথে এখানে ধর্ম,মনুষ্যত্ব এবং তখনকার রাজনীতির ভিউটা তুলে ধরেছিলেন।
দ্বিতীয় বইটি ছিল " পদ্মার পলিদ্বীপ "
এক অসাধারণ বই ছিল। যেমন করে ধর্ম ব্যবসাকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়েছেন তেমনি দেখিয়েছেন এক অনবদ্য প্রেম কাহিনী সাথে চরের মানুষদের জীবনী।
আবু ইসহাক মানেই ধর্ম বর্তমান মানে তখনকার রাজনীতি ভিউ,মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার টা তুলে ধরা।
'পদ্মার পলিদ্বীপ' কে চরের মানুষদের জন্য একটা ডকুমেন্টারি ও বলা যায়। ফজল এবং রুপজানের প্রেম অপর দিকে প্রথম নাবালক স্ত্রী জরিনার প্রেম।
পিতা এবং ভাই হত্যার প্রতিশোধ অন্য দিকে নিজেদের চরের ভিটা রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা। জহিরুল্লা এক ভয়ংকর শত্রু। সব মিলিয়ে পিওর মাষ্টার পিস একটা বই ছিল " পদ্মান পলিদ্বীপ "।
তৃতীয় বই ছিল "জাল "।
১৯৪৭ এর দেশ ভাগ হবার পর,অনেক মুসলিমই ভারত ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসতে শুরু করে। সেখানে তারা অত্যাচারিত হওয়া শুরু করলে কোনো রকম জান বাঁচিয়ে চলে আসে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অনেক হিন্দুই তখন তাদের সাথে জায়গা অদল-বদল করে। এই সব মানুষ গুলোকে ব্যবহার করেই একদল জাল নোট ব্যবসায়ী মাঠে নামে। এই ব্যবসায়ীর দল,সুন্দর একটা নিয়ম চালু করে । যারাই ভারত থেকে এই দেশে আসে,তাদের কে জাল নোট ধরিয়ে দেয় আর সোনার দোকান তাদের আসল টার্গেট থাকে।
তখনই ডাক পড়ে ধুরন্ধর গোয়েন্দা মিষ্টার রেজার। অনেক আগেই চাকরি ছেড়ে অবসরে গেছেন,কিন্তু দেশের এই দূরাবস্থায় তো ঘরে বসে থাকতে পারেন না। আবার বয়সের ভারে দৌড়াতেও পারেন না। কিন্তু তুর্কির এক জুনিয়ার গোয়েন্দা ইলিয়াসের উপর এই দায়িত্ব দেন রেজা। তারপর শুরু হয় সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানের জেলায় জেলায় সন্দেহ। একের পর এক গোপন রহস্য বের হতে শুরু করে। কিন্তু হুট করে দেখা মিলে কিছু চিঠির, যার ভেতর থাকে গোপন বার্তা আর সেই চিঠি গুলো লেখা বিভিন্ন রকম সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে। এই চিহ্ন গুলো কি? কিভাবে খুঁজে বের করবেন সেই জাল নোটের গডফাদারকে?
এমন ভাবেই গল্পটি শেষ হয়।' জাল' , আমার মনে বাংলাদেশের জন্য শুধু তখনকার নয়, বর্তমানেও সেরা একটা বই । যেমন স্মার্টনেস দেখিয়েছেন লেখক তা পশ্চিমা বই ছাড়া কখনো পাওয়া যায় না। এক কথায় অন্য রকম এক বই।
গল্পসমগ্র:-
ছোট গল্প, শুধু আমার একান্ত না, সবারই ভালো লাগার কথা এই সব ছোটগল্প গুলো ।
১.মহাপতঙ্গ :-
কত সুন্দর করে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে গেছেন আধুনিকতা মানেই যে শুধু সুফল নয়, ভয়ংকর ধ্বংসও তা খুব সহজে বুঝতে পারবেন। যদি এটা ইংরেজি সাহিত্য হত অথবা আপনাদের জন্য ভারতীয় বাঙালদের লেখা হত, তবে এটা হত মাষ্টারপিস।
২. ঘুপচি গলির সুখ:-
আহা কি পড়লাম? এক অসাধারণ লেখা।
৩. প্রতিবিম্ব :-
এত সুন্দর রুপক অর্থে লেখাও হয় যা বোঝানোর মতো নয়।
৪. জোঁক :-
এটা হল মিষ্টির মতো। এটার কথা বলেই শেষ করি। যদিও আরও ছয় থেকে নয় টা ছোটগল্প আছে। আমার কাছে এই গুলোই পিওর মাষ্টারপিস ছিল।
যাই হোক জোঁকটার সাথে আমাদের অনেক আগে থেকেই পরিচয়। মাধ্যমিক স্কুলে থাকতেই পড়েছি। তবুও দুলাইনে মনে করিয়ে দেই।
জোঁক হচ্ছে, আমাদের জমির মালিক। যারা চাষীদের বুকে পা দিয়ে মুখের খাবার কেড়ে নেয়।
এই ছিল আমাদের আবু ইসহাক এর লেখক পরিচিতি। তা এই কয়টা বই যদি এক মানুষকে কালজয়ী হতে সাহায্য করে তবে বুঝুন কেমন লিখেছেন তিনি?
আমি লিখে দিতে পারতাম,যদি তিনি ইংরেজি সাহিত্যিক হতেন, তবে আজকে এই কয়টা বইও নয় শুধু মাত্র ছোট গল্পের জন্যই পৃথিবী উনাকে মনে রাখতেন।
সাহিত্যে পুরস্কার অর্জন স্বরুপ:-
বাংলা একাডেমি পুরুষ্কার (১৯৬৩)
একুশে পদক (১৯৯৭)
স্বাধীনতা পদক মরণোত্তর (২০০৬ )
ইত্যাদি পুরষ্কারে ভূষিত হন তিনি।
২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন এবং এই মহান লেখক কলম থামিয়ে দেন।
"বাংলাদেশী বই পড়ুন,লেখকদের জানুন এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে জানাতে চেষ্টা করুন"।
ধন্যবাদ।
-নরকীট
0 Comments