পদ্মা বহুমুখী সেতু
"পদ্মা বহুমুখী সেতু" নির্মান বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ। পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত এই সেতু লৌহজং, মুন্সিগঞ্জের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর কে অর্থাৎ দেশের দক্ষিন-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশকে যুক্ত করবে। প্রথমে এই প্রকল্পে শুধুমাত্র সড়কপথ নির্মাণ এর কথা উল্লেখ থাকলেও পরবর্তীকালে বর্তমান সরকার রেলপথ নির্মাণেরও সিদ্ধান নেন। বর্তমানে এই সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়কপথ ও নীচের স্তরে একক রেলপথ নির্মিত থাকবে। এই সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিমি ও প্রস্থ ১৮.১০ মি। বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতু, এগারোতম স্থান দখল করে নিয়েছে। এই সেতুর নকশা তৈরী করেছেন A.E.C.O.M। পদ্মা সেতু নির্মাণের দায়ভার দেওয়া হয়েছে, চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিঃ কে। বর্তমানে এই সেতুর নির্মাণের সমস্ত ব্যয় বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে করা হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই সেতু 2020 সালের শেষের দিকে উদ্বোধন হওয়ার কথা থাকলেও, এই সেতুর নির্মাণকারী সংস্থা চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিঃ জানিয়েছেন, এই মূহুর্তে জনসাধারণের জন্যে কিংবা যান চলাচলের জন্যে এই সেতু এখনো তৈরী নয়, মোটামুটি ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করে যেতেই হবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাস:
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট। ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ করে এই প্রকল্প পাস করেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রথম পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১১ সালের প্রথম দিকে এই কাজ শুরু ও ২০১৩ সালের মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রকল্প বিভিন্ন দুর্নীতি কাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ফলে বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলো অর্থ বিনিয়োগে পিছিয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে পড়ে নির্মাণ কাজ। পরবর্তীতে অর্থাৎ ২০১১ সালে বর্তমান সরকার এসে এই পরিকল্পনা পুনরায় গ্রহণ করেন ফলে চার লেন বিশিষ্ট সড়কপথের সঙ্গে নীচের স্তরে একক রেলপথ নির্মাণেরও পরিকল্পনা সংযুক্ত করা হয়। বর্তমানে সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মাসেতুর নির্মাণের কাজ চলছে। জনসাধারণ ও যান চলাচলের জন্যে এই ব্রিজ খুলে দেওয়া হবে আনুমানিক ২০২২ সালের, এপ্রিল মাসের দিকে।
পদ্মা সেতু দুর্নীতি কান্ড:
পদ্মা সেতুর কেলেঙ্কারিতে আওয়ামী লিগ সরকারের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন নেতাদের নাম উঠে আসে। নির্মাণকারী সংস্থাকে নির্মাণকারী চুক্তির বিনিময়ে বেশ পরিমাণ অর্থের দাবী জানায়। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক সংস্থা এই দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিনিয়োগ তুলে নেন। যদিও কানাডীয় আদালত এই অভিযোগ খারিজ করেছেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ব্যক্তিগত সম্পদের অর্থায়নে এই প্রকল্প পুনরায় চালু করেন।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
দেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে পদ্মা সেতুর অবদান নিঃসন্দেহে প্রশ্নাতীত।
"পদ্মা বহুমুখী সেতু" দেশের কেন্দ্রর সঙ্গে দেশের দক্ষিন পশ্চিম অংশকে যুক্ত করবে। এছাড়াও দক্ষিন-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশকে সরাসরি যুক্ত করবে। এর ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটবে। এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের অনুন্নত অঞ্চলগুলো বিশেষভাবে লাভবান হবে ও উন্নত হবে। পদ্মা সেতুর মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতে গ্যাস, রেল, বৈদ্যুতিক লাইন ও কেবল সম্প্রসারনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ ক্রিয়া :
পদ্মা সেতুর পিলার নির্মাণে নির্মাণকারী সংস্থা বেশ উন্নতমানের ও সফল এক প্রক্রিয়া গ্রহণ করেন, যা বিশ্বের মধ্যে বেশ বিরল। এ এক বিরাট সাফল্য। নদীর তলদেশে মাটি না পাওয়ার কারনে, কৃত্তিম উপায়ে নতুন মাটি তৈরি করে অর্থাৎ স্ক্রিন গ্রাউন্টিং পদ্ধতিতে পিলার বসানো হয়।
২০১৭ সালে প্রথম স্প্যান বসানোর কাজ শুরু করা হয়। এরপর আরও ৪০ টি, সর্বমোট ৪১ টি স্প্যান বসানোর মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ পদ্মা সেতুটি দৃশ্যমান হয়।
পদ্মা সেতু সম্পর্কিত গুজব:
পদ্মা সেতু নির্মাণকালে দেশের জনগণের মধ্যে এক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই গুজব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে মানসিক ভারসাম্যহীনদের অপহারনকারী ভেবে মারধরের ঘটনা ঘটতে শুরু করে।
আশা করা যায়, বহু প্রতিক্ষীত এই পদ্মা সেতু, দেশ ও জনগণের আর্থিক উন্নয়নের জন্যে বেশ ফলপ্রসূ হবে। পদ্মা সেতুকে পাথেয় করে, দেশের আর্থ-সামাজিক, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অনুন্নত অঞ্চলের উন্নতির মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠুক, আমাদের সোনার বাংলাদেশ।
0 Comments