Book review: খোয়াবনামা

 বই পর্যালোচনা 

বইয়ের নাম- খোয়াবনামা
লেখক- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
ধরন- উপন্যাস
প্রকাশনী- মাওলা ব্রাদার্স
প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬
পৃষ্ঠা সংখ্যা- ৩৫২


বিষয়বস্তু:

উপন্যাসটি মূলত ১৯৪৭ এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পূর্ব পটভূমিকায় লেখা। কাৎলাহার বিলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গিরিরডাঙা ও নিজগিরিরডাঙা গ্রামের মাঝি চাষী, জোতদার, আধিয়ার ও জমিদার কে কেন্দ্র করে গল্পের কাহিনী বিস্তৃত হয়েছে। এই গল্পে অন্যতম প্রধান চরিত্র তমিজের বাপ; সে রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটে বিল সংলগ্ন পাকুড়গাছের কল্পিত মুনসীর সঙ্গে সাক্ষাত এর আশায়। গ্রামের লোকের মত অনুসারে তমিজের বাপ এর কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা আছে যা সে পায় এই মুনসী থেকে এবং তার স্ত্রী কুলসুমের পাতানো দাদা ফকির চেরাগ আলির থেকে। যার থেকে সে পেয়েছে মানুষের খোয়াব এর অর্থ বলে দিতে পারার অলৌকিক ক্ষমতা। 
তমিজ মাঝি হলেও সে স্বপ্ন দেখে চাষী হওয়ার। জমি বর্গা নিয়ে ধান ফলিয়ে চাষীদেরও অবাক করে দিতে সক্ষম হয় সে। তার স্বপ্ন সে নিজস্ব হাল গরু কিনে জমিতে চাষাবাদ করে নিজের জমি কিনে নেবে। কঠোর পরিশ্রম করে সে অনেকটা গুছিয়েও নেয় নিজেকে। হুরমুতুল্লাহর মেয়ে ফুলজানকে বিয়ে করে তার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখে সে। সব কিছু সাজিয়ে নেয় মনের মত করে কিন্তু কাৎলাহার বিলে অন্যায়ভাবে মাছ ধরার জন্যে বিলের স্বত্ব নেওয়া শরাফত মন্ডল তমিজের বাপকে খড়ম দিয়ে আঘাত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামের মাঝি আর চাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে রেষারেষি ঘনীভূত হয়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। খুনোখুনিও বাদ যায় না।
এছাড়াও আরেকদিকে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক হানাহানি ১৯৪৭ এ বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তান এর পক্ষে গ্রামে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক দল। যেই গ্রামে সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকত সেখানে ধীরে ধীরে শুরু হল জাতিগত বিদ্বেষ। গ্রামের প্রাচীন হিন্দু পরিবারগুলো একে একে দেশ ত্যাগ করা শুরু করল। অন্যদিকে ভারতে মুসলিম দের ওপর অত্যাচারের বিবরণ ও তাদের দেশ ছেড়ে চলে আসা এসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাব গ্রামের সাম্প্রদায়িক হানাহানি বৃদ্ধি করে। তছনছ হয়ে যায় কতগুলো সাধারন মানুষের জীবন। তমিজের স্বপ্ন সংসারে ভাঙন ধরে। শরাফত মন্ডলের ছেলে ও পাকিস্তান এর পক্ষে রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান কাদের এর সাহায্যে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচে সে। কিন্তু তার স্বপ্ন থেমে থাকে না। সে কল্পনাতেই জাল বুনতে থাকে তার সুন্দর গোছানো ভবিষ্যত এর। ওদিকে ফুলজানও তাদের মেয়েকে নিয়ে পথ চেয়ে থাকে তমিজের। তার অপেক্ষার শেষ হয় না।

এছাড়াও উপন্যাসে আরও অনেক চরিত্র রয়েছে, রয়েছে বাস্তব অলৌকিক ঘটনার বিবরন। যার স্বাদ নিতে হলে উপন্যাস টি পড়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

নিজস্ব মতামত:

নিঃসন্দেহে লেখক এর এক অসাধারণ সৃষ্টি এই উপন্যাসটি। লেখক একদিকে যেমন বাস্তব ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন। মানুষের জীবনের বিপর্যয়, ভাঙন, সম্পর্কের অবনতি চুড়ান্ত পরিনতি কঠোর বাস্তব অন্যদিকে অলৌকিক জগত, পল্লীর মানুষের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, খোয়াব এর বৃত্তান্ত তার ওপর গ্রামের মানুষের চুড়ান্ত বিশ্বাস ও জীবনধারা এই দুইদিকের মধ্যে দিনরাতের পার্থক্য থাকলেও লেখক উপন্যাসের মধ্যে এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন অত্যন্ত পটুতার সঙ্গে যার দরুন পাঠকও বই পড়াকালীন এই খোয়াবনামা, মুনসীর বৃত্তান্ত কে সত্যি বিশ্বাস করতে বাধ্যই হবেন। অজস্র চরিত্রের উপস্থাপন করলেও প্রতিটি চরিত্রই স্ব-মহিমা নিয়ে উপন্যাসে বিরাজমান। যার কারনে এতটুকু বিরক্তি আসে না পড়াকালীন। অদ্ভুত ঘোর তৈরি হয় খোয়াব, মুনসী অলৌকিক ঘটনার দরুন। বাংলাদেশ এর সাহিত্য জগতে 'খোয়াবনামা' অবশ্যই চিরকালীন শ্রেষ্ঠ উপন্যাস গুলোর মধ্যে থেকে একটি হয়ে থাকবে। 




-শ্রী

Post a Comment

0 Comments