কাব্যগ্রন্থ পর্যালোচনা
বইয়ের নাম- বিষণ্ণ নগরী
কবি- রেজাউল করিম
ধরন- কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশনী- বহুমাত্রিক প্রকাশনা
প্রকাশকাল- সেপ্টেম্বর, ২০১৯
পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১২৪
মোট কবিতা- ৭২ টি
মূল্য- ২৭৫ টাকা
উপন্যাস, ছোটোগল্পের রিভিউ আগে লেখা হলেও কাব্যগ্রেন্থর রিভিউ এই প্রথম। বইটির ব্যাপারে যদি কিছু জানাতে হয় তাহলে বলে রাখা ভালো বইটি কবি রেজাউল করিমের প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
বইয়ের বেশিরভাগ কবিতায় কবির ব্যক্তিগত হতাশা, বিষন্নতা ফুটে উঠেছে,সেটা হতে পারে প্রেম, দেশ অথবা নিজের অসহায়তার প্রতি। সেদিক থেকে বইয়ের নামকরণ সার্থক।
বইয়ের প্রেম-বিরহ পর্যায়ের কয়েকটি কবিতা রয়েছে। সেই কবিতাগুলোতে কবি তাঁর ভালোবাসার মানুষের প্রতি তাঁর মনোভাব, আবার কখনো তাকে ছুঁয়ে দিতে না পারার আক্ষেপ, ব্যর্থতা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বেদনাকে খুব সহজ সরল ভাষায় অথচ গভীরতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন।
'আমার জন্য' কবিতাটিতে কবি ব্যাকুলতার সঙ্গে তার চাওয়া পাওয়া গুলোকে ব্যক্ত করেছেন যা ছা-পোষা হলেও কবির আক্ষেপ থাকবে না কিন্তু এর জন্যে ঘুণে খাওয়া সভ্যতা-সমাজের গান তিনি গাইতে পারবেন না। প্রিয় কয়েকটি লাইন-
"আমার জন্য
বহু পুরোনো কোনো বই হলেও চলবে।
যার প্রথম পাতায় ছাড়পোকাদের চিহ্ন,
আর শেষ পৃষ্ঠায় কোনো প্রেমিকার ঠিকানা।
..........
শুধু বলো না আমায়
তোমাদের তথাকথিত
ঘুণে খাওয়া সভ্যতা দেখতে"।
এরপরে বইটিতে যা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় তা একাকীত্ব, বিষন্নতা।"কেউ নেই", "একাকীত্ব", "কবর" কবিতায় কবি নিজের একাকীত্ব কে কবরে কাটানো প্রথম রাতের সাথে তুলনা করেছেন। ঈশ্বরও তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এই দুঃখ, একাকীত্বই সংসার। এই দুঃখ না কবিকে মুক্তি দিয়েছে না কবি মুক্তি দিতে পেরেছেন নিজেকে।
"হায় দুঃখ!
১২১ টা পৃথিবীর দুঃখ তুমি, আমার একাকীত্ব,
তুমি না দিলে আমার আমি কে মুক্তি,
আবার আমিই না পারলাম তোমায় মুক্তি দিতে।
এখন তুমি আমার সংসার,
আমার ভালোবাসা,
এবং
আমার ১২১ টা পৃথিবীর দুঃখ তুমি"। (কবিতাংশ- "একাকীত্ব")
এরপরে আরেকটি কবিতা যেটি আমার বেশ পছন্দের, "প্রেমের প্রার্থনা"। কবিতার নামটি ব্যঙ্গাত্মক। প্রেমের প্রার্থনায় শুদ্ধ প্রেম চায়না কেউ। প্রেম মানে এই বোকা মনুষ্যর কাছে টাকা, ক্ষমতা আর দেহ। প্রভু সমাজে শুদ্ধ প্রেম দিতে সাড়া দিয়েছিলেন এই প্রার্থনায়, কিন্তু হায়!বোকা সমাজ ভালোবাসার বদলে বেছে নিল হানাহানি,লোভ, ক্ষমতা।
দেশ, দেশমায়ের প্রতি কবির ভালোবাসা, আক্ষেপ দুই'ই প্রকাশিত হয়েছে কিছু কবিতায়। "দেশমায়ের বার্তা" কবিতায় কবি দেশমাতার হাহাকারের মধ্যে ব্যক্তিগত আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলেছেন। রক্তপাত, মৃত্যু, হাজারও ধর্ষণ, বলিদানের মাধ্যমে যে দেশমাতাকে স্বাধীন করা হয়েছিল সেই দেশমাতাকে আজ আমরা ভুলতে বসেছি। দেশ-দশের চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখছি। ভাসিয়ে দিয়েছি বিবেক সেইসঙ্গে দেশমায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।
"নামছাড়া", "প্রথম" কবিতা দুটোর দুটো পর্ব। কবিতাগুলোতে ভালোবাসার মানুষের প্রতি কবির আকুল আবেদন, কবির ভালোবাসা গ্রহণ করার আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। মানুষটি ভালোবাসার দেবী হয়ে কবির অনুভুতিতে ধরা দিয়েছে।
এরপর আরও একটি প্রিয় কবিতা " পৃথিবী সুন্দর"। তিনটি ভাগে কবি তাঁর মায়ের কাছে চিঠি লিখেছেন। ছোটোবেলায় আমাদের দুঃখ কষ্ট কোনোকিছুই মায়ের থেকে লুকানো থাকে না। কিন্তু যত বড় হতে থাকি তত যেন এই সংযোগ ছিন্ন হতে থাকে। আমরা একা হয়ে পড়ি। জানাতে পারি না মা কে, আমাদের একাকীত্ব, পৃথিবীর সঙ্গে ঝুঝে উঠতে না পারার ব্যর্থতার গল্প, তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।সব কিছু গোপনে চলে যায়। কবি তাঁর এই চিঠিতে মা কে সেসব জানাতে চেয়েছেন, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন।
"আমি ঘুমাবো মা।
তুমি তোমার স্রষ্ঠার কাছে একটু করুণা ভিক্ষা করে,
আমায় ঘুমাতে দিতে বলো মা।
আমি ঘুমাবো।
খুব ক্লান্ত মা আমি,
খুব ক্লান্ত"!
যেই মায়ের হাতের ছোঁয়ায় ঘুমিয়ে যেতাম একসময় সেই মায়ের কাছে এমন আকুতি সত্যি মন ছুঁয়ে যায়। এই অনুভূতি কবির একার নয়। পাঠকও নিজেকে মেলাতে পারবেন।এরপরে শেষ যে কবিতাটি নিয়ে আলোচনা করব তা হল, " সুইসাইড নোট"। কবিতাটিতে চরম হতাশা, ব্যর্থতা, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, ঈশ্বরের সঙ্গে নিজ সত্ত্বার বিদ্রোহ, প্রকাশ পেয়েছে। ঠিক সুইসাইডের আগের মুহূর্ত টি বর্ণনা করেছেন। কবির চোখের পাতায় হতাশা ছাড়া এখন কিছুই ভাসে না। এখন হাতের রগ কাটা,
প্রথম গভীর চুম্বনের থেকেও প্রিয়;
"হাতের রগ কাটলে আরামই হয়।
মনে হয়;
কেউ ভালোবেসে ঠোঁট চুষে দিচ্ছে,
প্রথম গভীর চুম্বনের স্বাদ হয় অখাদ্য"।
জীবনের পথে তিনি এতটাই ক্লান্ত এখন দেহও কবিকে মানতে চায় না। ঈশ্বরের সঙ্গে যেন বিদ্রোহে নেমেছেন কবি। ঈশ্বরের সৃষ্টিকে তিনি নিজ স্বেচ্ছায় শেষ করবেন। এ যেন ঈশ্বরের প্রতি একপ্রকার প্রতিশোধ। যেখানে কবি বেঁচে থাকতে পারতেন বিভিন্ন ভূমিকায় সেখানে এই পরিনতিতে, হতাশ হয়ে শেষে উচ্চারণ করেছেন,
"হায় আফসোস!
আমি লাশ হতে যাচ্ছি।
হবার কথা ছিল-
পিতা স্বামী অথবা মানুষ"।
৭২ টি কবিতা নিয়ে সবিস্তারে মতামত দেওয়া সম্ভব নয়। তবু চেষ্টা করেছি বইয়ের সারসংক্ষেপ বা ভাব ফুটিয়ে তুলতে, আর সব প্রিয় কবিতার মধ্যে কয়েকটি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করতে। আশা করি ভালো লাগবে।
বইয়ের প্রতিটা কবিতা সাধারন ভাষায় লেখা, তবু ভাবের গভীরতায় ভাঁটা পড়েনি। মনের ভাবকে সহজ- সরলতা মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কবিতার সার্থকতা হল, অনুভূতি ও ভাব কে পাঠকের সঙ্গে একাত্ম করে তোলা। সেইদিক থেকে কবিতাগুলো সার্থক। কারন ভাষা বা রূপকের দুর্বোধ্যতা না থাকায় যে কেউ খুব সহজেই নিজেকে এই অনুভূতির সঙ্গে মেলাতে পারবেন।
ভুল ত্রুটিও অবশ্যই রয়েছে। কয়েকটি কবিতা আরেকটু মানসম্মত হওয়া উচিত ছিল। তবুও কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসাবে যথেষ্ট ভালো।
আশা করি সবাই নতুন নতুন প্রতিভাকে বিকাশের সুযোগ দিবেন। উঠতি কবিদের পাশে থাকুন। অনুপ্রেরণা দিন, সহযোগিতা করুন। কে বলতে পারে একটু সহযোগিতা পেলে কেউ কেউ হয়তো হয়ে উঠতে পারবেন কালজয়ী কবি অথবা লেখক।
ধন্যবাদ।
0 Comments