Article: বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির বিতর্ক

বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির বিতর্ক




অযোধ্যার বাবরি মসজিদ বনাম রাম মন্দির একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়।যুগ যুগ ধরে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে উত্থাপিত হয়েছে নানা ধর্মীয় বিবাদ, আদালতে মামলা ও পাল্টা মামলার বিবাদ।


এখন চলুন যাকে ঘিরে এই বিবাদের শুরু সেই বাবরি মসজিদের ইতিহাস জেনে নেই।

বাবরি মসজিদের ইতিহাস:-


ভারতের উত্তর প্রদেশে ফৈজাবাদ জেলায় অযোধ্যা শহরে রামকোট হিলের ওপর একটি প্রাচীন মসজিদ নির্মিত ছিল। মনে করা হয় মুঘল সম্রাট বাবর এর নির্দেশে তাঁর সেনাপতি মীর বাঁকি ১৫২৭–২৯ খ্রিস্টাব্দে (৯৩৫ হিজরি বর্ষে) এই মসজিদ টি নির্মান করেছিলেন। যেহেতু সম্রাট বাবর এই মসজিদের নির্মান করেছিলেন সেই থেকে তাঁর নামানুসারে এই মসজিদের নাম হয় বাবরি মসজিদ। কিন্তু ১৯৪০ সালের এর পূর্বে একে "মসজিদের জন্মস্থান" বলা হত।
 
ফৈজাবাদের ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী মনে করা হয়, ১৮৫৫ সাল অবধি হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সেই ভবনটিতে প্রার্থনা ও পুজা করতেন৷
কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পরে মসজিদের সামনের অংশ ঘেরাও করে দেওয়া হয়। ফলত হিন্দুরা বাইরের অংশে একটি ‘চবুতরা'র উপর তাদের পুজাপাঠ করতে থাকে৷ কিন্তু ১৮৮৩ সালে হিন্দুরা ঐ চবুতরার উপর একটি মন্দির নির্মাণের প্রচেষ্টা করলে জেলা প্রশাসন তা নিষিদ্ধ করেন৷

এবার আলোচনা করা যাক বিবাদের উৎস নিয়ে।




১৯৯২ সালে "কর সেবক" ( মন্দিরের শিলান্যাস এর সময় গঠিত বাহিনী) ও "বিশ্ব হিন্দু পরষদ" ও তার সদস্যরা মসজিদের ওপর হামলা করে গুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা ভারতবর্ষ ও ভারতের বাইরে বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়।যার দরুন ভারতে প্রায় দুই হাজার মানুষের প্রাণ যায়।
যদিও এই বিবাদের রেশ শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের শুরুর দিক থেকেই।

সেই সময় থেকেই হিন্দুরা দাবি জানাতে থাকে মসজিদের পরিবর্তে সেখানে মন্দির নির্মানের। তারা এও জানায় যে মীর বাঁকির মসজিদ নির্মানের পূর্বে সেখানে রাম মন্দিরই ছিল।যেটা ধ্বংস করে সেখানে তৈরি করা হয় বাবরি মসজিদ। যদিও এর সত্যতা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। 

১৯৯২ সালের মসজিদের ধ্বংসাবশেষ থেকে যে শিলালিপি পাওয়া যায় তা থেকে অনুমান করা হয় মসজিদের নিচে মন্দির ছিল।

আবার ১৯৪৯ সালে হিন্দু সক্রিয়তাবাদীরা হিন্দু মহাসভার সাথে জোট বেঁধে গোপনে রামের একটি বিগ্রহ মসজিদের ভেতরে রেখে আসে যার দরুন বিবাদ আরও জোরালো হতে থাকে যদিও পরে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে সেই বিগ্রহ সরিয়ে নেওয়া হয়।

এরপরই বিবাদ আরও ঘনীভূত হতে হতে অসাম্প্রদায়িক ভারতের বুকে ঘটে যায় সেই কলঙ্কিত ঘটনাটি।

বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির নিয়ে মামলা:-





হিন্দু ধর্মের একান্ত বিশ্বাস অযোধ্যায় যেখানে বাবরি মসজিদ নির্মিত সেটি আসলে রামের জন্মস্থান। তাই রামের জন্মস্থানে রাম মন্দিরই হওয়া উচিত। তাই এই মন্দির নির্মানের উদ্দেশ্য কে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে ১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটি কমিটি গঠন করে। 
এরপর ১৯৮৬ সালে বিচারক নির্দেশ দেন মসজিদের দরজা খুলে দিয়ে সেখানে যেন হিন্দুদের উপাসনা করতে দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে মুসলিমেরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে।

আবার ২০০৩ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এর উদ্যোগে ভারতের ভূমি জরিপ বিভাগ এই স্থানের খনন কার্য শুরু করেন।নিচে যদিও একটি পুরাতন স্থাপনার হদিশ মিলেছিল কিন্তু আদৌ তা রাম মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ নাকি তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে এই মামলা। 

দীর্ঘ বছর পর ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয় , সেই বিতর্কিত জমিটির এক তৃতীয়াংশ মুসলিম, এক তৃতীয়াংশ হিন্দু ও বাকি অংশ নির্মহী আখড়া নিয়ন্ত্রন করবে। কিন্তু মসজিদ যেখানে ছিল জমির সেই অংশটুকু হিন্দুদের ভাগে পড়ায় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড পুনরায় মামলা দায়ের করে।

এরপর ৯ নভেম্বর ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত সেই বহুল অপেক্ষিত ও বিতর্কিত মামলার চুড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। এই রায়ে বলা হয় যে, জমির ২.৭৭ একর একটি ট্রাস্ট কে দিতে হবে যাদের উদ্যোগে রাম মন্দির নির্মান করা হবে। আর ৫ একর জমি মুসলিমদের দেওয়া হবে মসজিদ নির্মানের জন্যে এবং সে জমি অযোধ্যায়ই হতে হবে। 

রায় বেরোনোর পর বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি কতগুলো অভিযোগ তুলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অন্যতম প্রধান আইনজীবী জাফরইয়াব জিলানি অবশ্য বলেন, এই মামলার আবার শুনানি প্রয়োজন। এক স্বাক্ষাতকারে তিনি বলেন-
"রায় বেরোনোর পরেই কয়েকটি বিষয়ে ত্রুটি আছে বলে আমার মনে হয়েছিল। সেজন্যই আমি মনে করছি যে রিভিউ হওয়া উচিত।
"একটা কারণ হল, এক নম্বর বাদী - ভগবান রামলালার মূর্তি, যেটি ১৯৪৯ সালে মসজিদের ভেতরে বসানো হয়েছিল, সেটি বেআইনি ছিল বলে জানিয়েছে কোর্ট। যে মূর্তিটি বেআইনিভাবে বসানো হয়েছিল বলে শীর্ষ আদালতই জানাল, সেটিকেই জমির অধিকার দেওয়া হল!"

"এছাড়া, আদালত তো এটাও স্বীকার করেছে যে অন্তত ১৮৫৭ সাল থেকে ১৯৪৯ অবধি সেখানে নামাজ পড়া হত। তার অর্থ, ওই সময়কালে মুসলিমদের দখলে ছিল ওই জমিটি! এই দুটো বৈপরীত্য কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না আমার," এমনই মত প্রকাশ করেছিলেন মি. জিলানি।

এখন প্রশ্ন হল আদালত কোন প্রমাণের ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছিলেন। আইনজীবী জাফরইয়াব জিলানির বক্তব্যর সাথে সাথে আরও কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। সেটা হল সম্রাট বাবরের নির্দেশে মীর বাঁকি যখন সেখানে মসজিদ নির্মান করেছিলেন নিশ্চয় তখনকার নিয়ম অনুযায়ী সেই জায়গা দখল করেই মসজিদ নির্মান করেছিলেন।সুতরাং সেই অধিকৃত জমিতে মসজিদ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত।
আর দ্বিতীয়ত যেখানে মুসলিমেরা প্রায় এক শতাব্দী ধরে সেই জায়গায় নামাজ আদায় করে এসেছে, সেখানে বলতে গেলে এই জায়গা তাদেরই অধিকার সবচেয়ে বেশি। মালিকানা স্বত্ত বিহীন কোনো জমিতে কিছু বছর থাকলে আইনত ভাবে সেই জমির অধিকার তারই প্রাপ্য। 

তাই বলতে গেলে এই জমি নিয়ে যে রায় নিষ্পত্তি করা হয়েছে তা অনেকটাই নিরপেক্ষহীনতার স্বীকার। কোনো প্রমান ছাড়া রাম মন্দির স্থাপন করার রায় টি আদৌ কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

Post a Comment

0 Comments