গল্প: প্রিয়ন্তীর গল্প ২

 গল্প: প্রিয়ন্তীর গল্প ২




"মুখ তুলে চায় সুবিপুল হিমালয়,
আকাশের সাথে প্রণয়ের কথা কয়,
আকাশ কহিছে ডেকে
কথা কও কোথা থেকে?
তুমি যে ক্ষুদ্র মোর কাছে মনে হয়!!

হিমালয় তাই মূর্ছিত অভিমানে,
সে কথা কেহ না জানে।
ব্যর্থ প্রেমের ভারে
দীর্ঘ নিশাস ছাড়ে _____
হিমালয় হতে তুষার ঝড় বয়"!!

প্রিয়ন্তী:তোমাকে আমি বলেছি সুকান্তের কবিতা আবৃত্তি করতে?
সাহেদ: না তবে...
প্রিয়ন্তী: তবে তবে তবে টা কি? 
সাহেদ: কিছু না, আমি দুঃখিত।আসলে এটাই চোখ বুজে মনে পড়ে গেছে,তাই বলে দিলাম!
প্রিয়ন্তী: তাই বলে তুমি আমাকে একটা রোমান্টিক কবিতা শোনাতে পারোনি?
সাহেদ:আচ্ছা আরেকটা বলব?
প্রিয়ন্তী :এটাও কি তোমার সুকান্ত বাবুর?
সাহেদ:শুনলেই বুঝবে....

"কান্তার পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আধারে,
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল তোমারে চাই ;
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যর্থিত তোমার দু চোখ............

কবিতা চলতে থাকে,সন্ধ্যা নামে পৃথিবীর বুকে,দুজন মানুষ দুজনার মধ্যে ব্যস্ত। একজন চাইছে অন্য জনের রাগ ভাঙাতে অন্য জন চাইছে রাগটা আরও বাড়ুক। তাহলে হয়তো গাধাটা মোটা চশমাটা হাতে নিয়ে,শার্টের হাতা দিয়ে গ্লাস পরিষ্কার করে, আবার চুলে আঙ্গুল দিয়ে নতুন কবিতা মনে করার চেষ্টা করবে।
কিন্তুু হয়না,বোকা আর মোটা ফ্রেমের চশমার মালিক এই ছেলে গুলোর সাথে প্রিয়ন্তীর মতো মেয়েরা রাগ করে থাকে না।থাকে না বললে ভুল হবে,আসলে থাকতে পারে না।

সাহেদ প্রিয়ন্তীর বাসায়, ঠিক উপরের তলায় থাকে। তাদের বাসার ছাদের সিড়ির রুমে।
বাসার চার দিকে ভালোই পরিবেশ। তাদের ছাদে কিছু প্রিয় ফুলের গাছ আছে, যাতে পানি দেওয়ার সময়টা হয়ে উঠে না,প্রিয়ন্তী নামের চিকন,শ্যামবর্ণের মেয়েটার। কেমন জানো অতিরিক্ত ফাজিল।বান্ধবী থেকে শুরু করে ঘরের বাবা মা কেউই রক্ষা পায় না। ঠিক এই ফাজিল মেয়েটা কেমন যেন মলিন হতে শুরু করল।
একটা মোটা চশমার চারপাশ ভুলে থাকা মানুষের জন্য। যে কিনা একটা কবিতার বই পেলে পৃথিবী ভুলে যেতে পারে, একটা কম দামী শালে শীত চলে যায়,যার চশমা পরিষ্কার করার জন্য ময়লা শার্টটাই যথেষ্ট। 
মেয়েটার প্রেমে পড়াও ছিল অন্য রকম।
মেয়েটা প্রতি শনিবারে গাছে পানি দিবে, ঠিক সময়টা হবে বিকাল বেলায়।
তখনই দেখে,শেষ বিকালের আলোয় তাদের বাসার সেই ছেলেটি যে এক সপ্তাহ হল বাসায় উঠছে। সে গাছে পানি ঢালছে আর নিজে নিজেই একটা কবিতার বই পড়ছে। চুল গুলো এলোমেলো,ইয়া বড় বড় দাড়ি, মোটা চশমা,মনে হচ্ছে কোনো একজন মহান কবি কবিতার বই পড়ছে।
তখনই প্রেমের দেবীর প্রেমের তীরটা প্রিয়ন্তীর বুকে গর্জন করে উঠে।আর তার আঠারো বসন্তের প্রেমহীন রুক্ষ ভূমিতে প্রেমের চাষ শুরু।

প্রিয়ন্তী: এই যে কবি সাহেব..
সাহেদ: জ্বি বলেন।আর আমি কবি নই,কবিতা পড়তে ভালোবাসি।
প্রিয়ন্তী: তাহলে কবিদের ভাব ধরে বসে আছেন কেন?
সাহেদ: কবিদের ভাব মানে? কবি হলেই কি এমন করে থাকে?
হেসে উঠল প্রিয়ন্তী।রাগ হবার দরকার এই জায়গায় ,কিন্তুু না মনে হচ্ছে এই ছেলের উপর রাগ করা আর নিজের ভাগের ভালোবাসা অন্যকে দেওয়া একই।
প্রিয়ন্তী : হুম,এমনই তো!
সাহেদ: না,কবিরা প্রকৃতির মত থাকে। আমি প্রকৃতির মত না। টাকার অভাবে এই অবস্থা।
আপনি তাহলে বাড়িওয়ালার মেয়ে প্রিয়ন্তী?
প্রিয়ন্তী: হুম। আর সরি,আসলে এইভাবে বলা ঠিক হয়নি! তবে আপনাকে কিন্তুু কবি কবি লাগে।
সাহেদ: হাহা বেশীরভাগ কবি মনে হয় আমার মতো ছিল। তাই না?
প্রিয়ন্তী: জানি না। আসি এখন,আর ধন্যবাদ আমার গাছ গুলোকে যত্ন করার জন্য।
সাহেদ: হুম।
বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে, উদাস হয় সে।

তারপর আর কি,নিয়ম করে প্রেমে পড়ল একজন। অন্যজনের তো সেই প্রেমে পড়তে হবেই। এই ধরনের প্রিয়ন্তীরা কাঁদে না, কাঁদায়ও না। ঠিক ৮০ দশকের পুরানো শেওলা পড়া বাড়ি গুলোর বেণী করা মেয়েদের মতো ওরাও সুখে থাকে। 
তারপর আর কি? সাহেদ কবিতা শুনায়, প্রিয়ন্তী সরল কথা বলে। অভ্যাস মতো প্রেমে পড়ে সাহেদও। আর বাড়ির ছাদে চলতে থাকে প্রেমের রাগ অভিমানী কবিতার খেলা।

তাদের সম্পর্কের বয়স চার বছর।সাহেদের জব পাবার ঠিক এক বছর পর আর তাদের সম্পর্কের চার বছরের মধ্যে প্রথম একদিন প্রিয়ন্তী সাহেদের ঘরে ঢোকে।
প্রিয়ন্তী:সাহেদ শোনো, বাবা কে তোমার কথা বলেছি.....
সাহেদ: কি? 
প্রিয়ন্তী: এইভাবে তাকিয়ে থাকার অর্থটা কি শুনি?
সাহেদ: তাহলে তো বাড়ি ছাড়তে হবে,নতুন বাসাও খুঁজতে হবে। কেন যে বলতে গেলে!
তোমার বাবা এখনই আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে। তাহলে কি আমি এখনও এখানে বসে থাকব?
বলেই জামা কাপড় নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।

প্রিয়ন্তী: তুমি কি বলতে চাইছো?তাহলে কি আমি সারা জীবন কুমারী থাকব? বিয়ে করব না?নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো,মনে হয় ৪০বছরের বুড়ো!আর আমাকে তো মনে হচ্ছে,৩ সন্তানের মা!
সাহেদ: আমি কি সেটা বলেছি?
প্রিয়ন্তী : গাধা কোথাকার,তোমার জব আছে। আর বাবাও তোমাকে পছন্দ করে। চার বছর ধরে ওনাকে বুঝিয়েছি তাই রাজি হয়ে গেছে। খুব কম করে বুঝিয়েছি। আমি তো পাগল নই, যে ধপ করে বলে দিব আর তোমাকে হারাব!

সাহেদ: ও, সত্যি?
প্রিয়ন্তী: দাঁত বের করে লাভ নাই,তোমার চাচা চাচীকে নিয়ে অন্য বাসায় উঠো। আমি কি ঘর জামাইর সাথে সংসার করব নাকি?
সাহেদ: চাচা,চাচীরা তো আসবে না।তুমি তো জানোই। আমার খরচ দিয়ে জায়গা সম্পত্তি রেখে পরিচয় না দেবার কথা বলছে ওনারা!
প্রিয়ন্তী: আচ্ছা ঠিক আছে,তাহলে আর কি করা? তবুও বলো গিয়ে, ওনাদের জন্যই তো তোমাকে পেলাম।
হাসতে হাসতে প্রিয়ন্তী ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বোকা ছেলেটা পেছনের পকেট থেকে পার্স থেকে মা বাবার ছবিতে হাত দিয়ে তৃপ্ত হয়।

ঠিক শেষ বিকেলে, গোলাপ গাছটার পাতার ফাঁকে সূর্যের মরা আলো দুজন মানুষের কপালে চুম্বন করে যাচ্ছে। একজন অন্য জনকে কবিতা শোনায়।

কোথাও নতুন দিন রয়ে গেছে না কি?
উঠে বসে সকলের সাথে কথা বলে,
সমিতির কোলাহলে মিশে,
তবুও হিসেব দিতে হয় এসে,কোনো এক স্থানে,কোনো এক কাউকে....!

-রেজাউল করিম

Post a Comment

0 Comments