Article: নেক্রোফিলিয়া

 নেক্রোফিলিয়া





শারীরিক রোগ বা ব্যাধি পৃথিবীর সকল স্তরের শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষের কাছে যেমন অতিপরিচিত সাধারন একটি বিষয় তেমনি এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও মানসিক ব্যাধি কিন্তু সর্ব স্তরের মানুষের মধ্যে সমানভাবে গৃহীত কিংবা পরিচিত নয়।

মানসিক ব্যাধি মূলত মন এবং আচরণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে যা মন কিংবা শরীরী লক্ষণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির,অস্বাভাবিক আচরণ তার ব্যক্তিগত জীবন সেইসঙ্গে সমাজকেও বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। 

যেমন,
সিজোফ্রেনিয়া,এই মানসিক রোগের লক্ষণ গুলো হল-অলীক প্রত্যক্ষন কিংবা যে জিনিসের উপস্থিতি নেই সেই জিনিসকে প্রত্যক্ষ করা।





এই সকল মানসিক ব্যাধিতে এরূপ অস্বাভাবিক আচরণ ও অধিকাংশ মানুষের তা বোধ ও ধারণার বাইরে থাকার কারনে, এটা তাদের কাছে কোনো রহস্য কিংবা ভূত,জ্বিনে ধরার মত কোনো অলৌকিক ব্যাপার।

তেমনভাবেই এমন আরও কিছু মানসিক ব্যাধি রয়েছে,যার লক্ষণ বা প্রকাশ রীতিমত শিউরে ওঠার মত।এই সমস্ত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি তাদের অস্বাভাবিক আচরণ কিংবা মনবাসনা পূরণ করার তাড়নায় অসামাজিক কাজেও লিপ্ত হয়ে পড়ে, যার কারনে এরা হয়ে উঠে সমাজের কাছে অপরাধী অথবা ঘৃণ্য। মানসিক ভারসাম্যতায় অসংলগ্নতা থাকার কারনে তারা তাদের উদ্ভট কিংবা ভয়ংকর ইচ্ছা, বাসনাকে দমন করতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে,যার কারনে তারা তাদের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে সর্বাধিক সীমাও অতিক্রম করে ফেলে।যার প্রকাশ তাদের আচরণে কিংবা শরীরের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়।
তেমনই একটা বিষয় নিয়ে আজকে আমি আলোচনা করব,যার নাম নেক্রোফিলিয়া( Necrophilia) বা নেক্রোফিলিজম বা নেক্রোলেগনিয়া প্রভৃতি।


●নেক্রোফিলিয়া কি:


নেক্রোফিলিয়া কথাটি এসেছে,গ্রিক শব্দ 'নেক্রোস' যার অর্থ হল 'মৃত' এবং 'ফিলিয়া' যার অর্থ ভালোবাসা বা আসক্তি।অর্থাৎ নেক্রোফিলিয়া কথাটির অর্থ হল,মৃত মানুষের প্রতি আসক্তি কিংবা ভালোবাসা। 
নেক্রোফিলিয়া কে WHO (World Health Organization )পরবর্তীকালে প্যারাফিলিয়া (Paraphilia)র অন্তর্ভুক্ত করেছেন।এর অর্থ বিকৃত যৌনাচার।
যারা নেক্রোফিলিয়ার মত বিরল রোগে আক্রান্ত হন,তাঁরা মৃত মানুষের শরীরের প্রতি আসক্তি অনুভব করেন এবং সহবাসে লিপ্ত হন।

●নেক্রোফিলিয়া আক্রান্তদের প্রকারভেদ:


1)এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ আছেন,যখন তারা তাদের সঙ্গীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হন,তখন তাদেরকে তারা মৃত হিসাবেই ধরে নেন বা কল্পনা করেন।

2)আরেক প্রকার আছেন,যারা তাদের মৃত ভালোবাসার মানুষের শরীরের প্রতি আসক্তি,কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেন না।যার ফলে তারা সেই মৃতদেহকে সংরক্ষণ করে দিনের পর দিন তাদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হন।

3)এদের মধ্যে কিছু আছেন যারা শুধুই কল্পনা করে যান মৃত মানুষের সাথে সহবাসে লিপ্ত হওয়ার,কিন্তু তা কখনো বাস্তবায়ন হয় না।

4)কিছু প্রকার রোগী শুধুমাত্র দেহ স্পর্শেই সীমাবদ্ধ থাকেন।

5)আবার অনেকে মৃত মানুষের সাথে সরাসরি লিপ্ত না হয়ে শরীরের বিশেষ অঙ্গ(যৌনাঙ্গ)কেটে নেন এবং তারপরে যৌনক্রিয়ায় মত্ত হন।

6)কিছু কিছু রোগী এমনও আছেন হয়তো কখনো তিনি মৃত মানুষের প্রতি আসক্তি অনুভব করেননি। কিন্তু দেখা যায় যদি এমন পরিবেশ বা সুযোগ তৈরী হয়, মৃত মানুষের সাথে সহবাসে লিপ্ত হওয়ার,তখন তারা সেই সুযোগ ছাড়েন না বা ছাড়তে পারেন না।

7)কোনো কোনো রোগী মৃত মানুষের সাথে যৌন ক্রিয়া সম্পাদনের উদ্দেশ্যে খুনও করে থাকেন।

8)কিছু প্রকার রোগী নিয়মিত রূপে এই কাজে আসক্ত হয়ে পড়েন।

●নেক্রোফিলিয়া রোগটি বিভিন্ন মানসিক বিপর্যয় কিংবা অস্বাভাবিক মনোভাবের কারণে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে,যাকে এক কথায় বলা যেতে পারে 'মোটিভ'।সেই কারন বা উদ্দেশ্য গুলি হল-


1)প্রত্যাখান হওয়ার ভয় এই রোগীদের মধ্যে মোটিভ হিসাবে কাজ করে থাকে।মৃত মানুষের কাছে এই ভয়টা কাজ করে না।

2)মৃত মানুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ।

3)নিজের হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষের সাথে সহবাসের ইচ্ছা।

4)জীবিত মানুষের সাথে যৌনকর্ম পাপ-এই বিশ্বাস থেকে অনেকে মৃত মানুষের সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হন।

5)নিজের যৌনসঙ্গীর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন এর তীব্র বাসনা-এই মনোভাবও মোটিভ হিসাবে কাজ করে থাকে।

6)স্বাভাবিক ভাবে যৌনসুখ প্রাপ্তিতে বিচ্ছিন্নতা।

প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের মোটিভ এই রোগে আক্রান্তদের ওপর কাজ করে থাকে।

●নেক্রোফিলিয়া রোগীদের উদাহরণ:


যদিও এই মানসিক রোগটি বিরল,তবু দেশ বিদেশে এই রোগে আক্রান্ত বিভিন্ন রোগীদের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে তথ্য হিসাবে।

1) অ্যান্থনি মেরিনো:
ইনি নিউ জার্সির হাসপাতালে কাজ করতেন।সেখানেই মৃত মানুষের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে গিয়ে ধরা পড়েন।সাত বছরের জেল হয় তার।


2)টেড বান্ডি:ইনি একজন সিরিয়াল কিলার এবং এই রোগে আক্রান্ত। তিনি যদিও ত্রিশ টি খুনের কথা স্বীকার করেছিলেন কিন্তু ধারনা করা হয়,এর থেকেও অনেক বেশি খুন তিনি করেছিলেন।খুন করার পর তিনি লাশের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতেন।



3)গ্যারি রিজওয়ে:
ইনি একজন আমেরিকান সিরিয়াল কিলার এবং উক্ত রোগে আক্রান্ত।তিনি প্রায় উনপঞ্চাশ জন নারী কে কিডন্যাপ করে হত্যা করেন।তিনি মূলত যৌনকর্মী ও বাচ্চা মেয়েদের অপহরণ করে,ধর্ষণ করে মেরে কোনো গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসতেন।পরে সেই স্থানে গিয়ে আবার মৃতদেহ গুলোর সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতেন।



4)এডমুণ্ড কেম্পপার:
ইনিও একজন আমেরিকান।যিনি দশজন মানুষকে হত্যা করার পর তাদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হন যাদের মধ্যে তার মা'ও ছিলেন।


5)লুইস ভার্মিলিয়া:ইনি একজন মহিলা সিরিয়াল কিলার ছিলেন।যিনি মৃতদেহ সৎকারের কাজ করতেন।কিন্তু তার আগে তিনি তাদের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতেন।



এমন আরো অনেক উদাহারন রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস এর লেখায়ও এই রোগীদের প্রসঙ্গ পাওয়া গেছে।প্রাচীন ঈজিপ্ট এ কারো স্ত্রী মারা গেলে সেই দেহ সৎকারের জন্যে সাথে সাথে দান করা হত না।দু-তিন দিন পরে তা বিকৃত হওয়ার পরে দান করা হত,যাতে কোনো নেক্রোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এর সুযোগ নিতে না পারে।

প্রচলিত মিথ অনুসারে, রাজা হেরোড তার স্ত্রী ম্যারিয়ানির মৃত্যুর সাত বছর পর্যন্ত মৃতদেহের সাথে যৌনকর্ম করেছেন। একই কাহিনি প্রচলিত আছে রাজা ওয়াল্ডিমার এবং রাজা চার্ল ম্যাগনের নামেও।

সাধারণত লাশকাটা ঘর বা মর্গে কাজ করে এমন লোকজন, ডোম, মৃতদেহ সৎকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি,কবরে বা সমাধিতে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে নেক্রোফিলিকদের খুঁজে পাওয়া যায়।এর বাইরেও নেক্রোফিলিকদের অস্তিত্ব আছে, যারা প্রয়োজনে লাশ চুরি করে থাকে।

যদিও এই রোগের কোনো চিকিত্সা নেই।তবুও নিয়মিত সাইকিয়াট্রিক কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে এই রোগীদের কিছুটা সাহায্য করা যেতে পারে বা তাদের এই বিকৃত মনবাসনাকে কিছুটা হলেও দমন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। তবুও এর লাভ কতখানি তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।তাই যুগ যুগ ধরে এই নেক্রোফিলিকদের অসামাজিক কাজ,তাদের বিকৃত আচরণ সমাজের কাছে যেমন ঘৃণ্য তেমনি ভয়ংকর অপরাধ হিসাবেই চিহ্নিত।

-শ্রী

Post a Comment

0 Comments