গল্প: অরুণা আর কবির গল্প

 গল্প: অরুনা আর কবির গল্প


সেই কবেকার পুরোনো একটা দোতালা বাড়ি,শেওলা আর ঝুলকালিতে ভর্তি।পুকুর পাড়ের বাড়িটায় একটা মেয়ে থাকে সাথে বাবা নিরুপম রায়। বড্ড সে কালের গোছের মানুষ!
মোটা চশমা আর পড়ার টেবিলে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হুমায়ূন পযর্ন্ত সব বই রয়েছে।
দেয়ালে ঝুলে আছে সাদা কালো কিছু ছবি, রেডিও তে বাজে-

"আমি তোমার বিরহে রহিব
বিলীন, তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি আর-কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে, তুমি যাহা চাও,
তাই যেন পাও,আমি যত দুখ পাই
গো॥"

:অরুনা অরুনা......
-জ্বি বাবা?
:তুই কি আবার সেই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কান্না করতে বসেছিস?
-না তো বাবা!তুমি শুধু শুধু ভাবনা করো মোরে নিয়ে।
:থাক থাক,আর রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা আমার লাগবে না!অন্তত চোখের পানিটা মুছে নাও! না হয় চশমা ঝাপসা হবে আর তুমি ধপাস করে মাটিতে পড়বে!তখন এই ডাক্তার কবিরাজ আমাকেই ডাকতে হবে!
খিল খিল করে হাসিতে মেতে ওঠে অরুনা! 
তারপর একটা আঙ্গুল নিয়ে চশমাটাকে মাঝ বরাবর ধরে খোলে আর আঁচলটা দিয়ে পরিষ্কার করে।
সামনে একটা সাদা কালো আর্ট করা ছবি, এক দিকে খুব ছোট সময়ের একটা মোটা আর চিকন মেয়ে হাসছে আরেক দিকে দুটাই চিকন যুবক যুবতী দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ দক্ষিণের বাতাসে জানালার পর্দাটা সরে যায়, ছবিটা নড়ে ওঠে। অরুনা জানালা দিয়ে দেখতে পায় পুকুরের ঐ পাড়ে একটা বাড়ি আছে,কিন্তু তার বাবা দেখে না।তার বাবা নিরুপম রায় বলেছে,ঐ বাড়িটা অনেক আগেই একটা ঝড়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। তার সাথে দেয়ালের ছবিটার ছেলেটা, রুপমেরও সমাধি হয়। 
বাবার কথা মিথ্যা নয়,যখন সে খুব ছোট, মাকে যখন সমাধি করে বাবা বাড়িতে আসে, বাবার চোখে জল দেখে অরুনা বলেছিল,
-বাবা তুমি কান্না করো কেন?মা কোথায়?
:তোমার মা আকাশের তারা হয়ে গেছে রে মা!
-কোনটা বাবা?
:ঐ যে তারাটা ছোট দেখা যায় ওটা!
-এত ছোট কেন বাবা তারাটা?আমার মা তো অনেক বড়!
:ঐখানে তো আজকে প্রথম দিন তাই!আস্তে আস্তে বড় হবে দেখো তুমি।
ঐদিনই বাবা অরুনাকে বুকে নিয়ে শেষ কান্না করেছিল আর কখনো কান্না করতে তার বাবাকে দেখেনি অরুণা।মেয়েকে মায়ের অভাবও বুঝতে দেননি তিনি। 
অরুনা সেই ছোট থেকে কথা বলে আসে তারাদের সাথে, কিন্তু যখন বড় হতে শুরু করল, আর সাইন্স নিয়ে পড়ল। তখন বুঝলো তারা তো বড় হয় না। তবুও বিশ্বাস করে আজও,একা হলে মায়ের সাথে কথা বলে অরুনা।
তাই সেও এখন বিশ্বাস করে রুপম আর নেই,যে চলা যাবার সে তো চলে যাবেই। 
কিন্তু ওটা ছিল কিশোর কালের ভালোবাসা। কেন জানি এখন মনে হয় পুকুর পাড়ে গিয়ে আবার বসতে। সেই কবে ৪ বছর আগে দুপুর বেলায় পুকুরে শাপলা ফুলে সাপে দের খেলা দেখতো অরুনা, আর মধ্য দুপুরে রোদ্রের খেলা। তখন চারটা হাত দুটি হাতে বন্দি থাকতো । পাশে থাকত রুপম।

গত দু বছর ধরে অরুনা খেয়াল করে,ওদের বাসার পাশে নতুন একটা বাড়ি গড়ে উঠছে। তার বাবার কাছে শুনেছে ঐ বাড়িতে নাকি একটা লেখক থাকে নির্বাণ রায় নামের। লেখকটা নাকি খুব ভালোই লেখে।মাঝে মাঝে অরুনা খেয়াল করে,যখন খুব জোছনা হয়, নির্বাণ এই পুকুর পাড়ে এসে বসে আর অরুনার ঘরের জানালার দিকে এক দৃস্টিতে তাকিয়ে থাকে।
অরুনার হাসি পায়। এত বড় ব্যাডা ছেলের ও প্রেম করতে মন চায়,তাও কিনা অষ্টাদশী অরুনার সাথে?
মাস্টার্স কবে নাকি শেষ করে বুড়ো হয়ে বসে আছে!
বিয়ে করতে মেয়ে খুঁজছে চার বছর ধরে, কিন্তু মনের মত পাচ্ছে না। তাই বলে শেষ পর্যন্ত শেওলা ধরা নিরুপম রায়ের বাড়িতে দেখতে হবে?
নিজেই দাঁত গুলো কিড়মিড় করে আর রাগে তার কানের লতি গুলোও লাল হয়ে ওঠে।
একদিন তো সাহস করে অরুনার ব্যালকোনিতেই উঠে এসেছিল,ঐদিন রাত্রেও ছিল প্রচুর জোছনা।অরুনা জানালার পাশে বসে Robert Frost এর 'The Road Not Taken' পড়ছিল-
"Two roads diverged in a yellow wood,
And sorry I could not travel both
And be one traveler, long I stood
And looked down one as far as I could
To where it bent in the undergrowth....;
হঠাৎ নিচ থেকে কি জানি উঠে আসার শব্দ পেয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থ হয়ে যায় সে!
তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল অরুনা।
দেখল নির্বাণ ব্যালকানিতে দাঁড়িয়ে ওর ঘুমিয়ে থাকা মুখের দিকে এক দৃস্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর থেকে মাঝে মাঝে এই কাজটা রুটিন হয়ে গেছে ছেলেটার। দু বছর ধরে যদি এমন চোর পুলিশের প্রেম চলে, তাহলে একদিন আর চোর পুলিশের প্রেম থাকে না,হয়ে যায় ভালবাসা।
এর মাঝে অরুনা বুঝতে শেখে,যা যাবার চলে গেছে, যেটা আসার,কাছে আসছে।না হয় একটা বার অষ্টাদশী অরুনা ২৮ বছরের ছেলেটার প্রেমে পড়ে দেখুকই না।
এখন মাঝে মাঝে বাবাও বলে, কিরে এখন তোর রবীন্দ্রনাথ তো শুনি না!ব্যাপার কি? কবি কি মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাত করে নাকি?
লজ্জায় মুখ লাল হয়ে ওঠে অরুণার।
-বাবা তুমি এসব কি বলো?
:কেন রে অরুনা মিছা বলি নাকি?মাঝে মাঝে দেখিতো কবি জোছনা দেখার নামে যে তোরেও দেখে!
-কি বাবা! তুমি জানো তবুও কিছু বলো না?
নিরুপম রায় একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে কিছু না বলে চলে যায়।
আজ রাত ১১ টা ৪৫ মিনিট, জোছনা এত তারাতারি এমন করে বেড়ে যাচ্ছে কেন? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে অরুনা। আয়নায় দাঁড়িয়ে সাজার শেষ চিহ্ন সবুজ বড় গোল টিপটা কপালে দিয়ে,নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে,আচ্ছা আমাকে কি হুমায়ূনের রুপা,নাকি রবীন্দ্রনাথের লাবণ্যর মত দেখতে?
জানালাটা খুলে আড়ালে দাঁড়ায় অরুনা, অপেক্ষা করে কখন আসবে কবি টা! 
ঠিক ১২ টা ১ এ যখন নির্বাণ ব্যালকনিতে উঠে আসবে তখনই ১৯টা লাল টকটকে গোলাপ গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে অরুনা কথা বলে ওঠে, আজকে উঠতে হবে না,পুকুর পাড়ে গিয়ে বসেন।
ধরা পরে যেন মেয়েদের মতো লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তরুন কবির নাক কান। মাথা চুলকিয়ে বলে আপনি ঘুমাননি?
আপনার মতো চোর থাকলে কি কোনো ভাবে ঘুমানো যায়?এখন যান গিয়ে পুকুর পাড়ে বসেন। 
মাথা চুলকাতে চুলকাতে নির্বান পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে।
৫ মিনিট পরে অরুনা কে দেখা যায়,যেন স্বর্গে বেঁধে রাখা হুর দের মধ্যে কোনো একটা হুর জোড় করে পালিয়ে আসছে তার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে।
কখন যে বাতাসে ভেসে অরুনা তার কাছে এসে বসেছে বলতেই পারবে না সে।নিজে নিজেই বলে ওঠে, 
"তুমি যদি থাকো পাশে
হাজার কবিতা ও যাবে ম্লান হয়ে!
আর তোমার দিকে তাকিয়ে সব কয়টা
কবিতায় দিবো আবার প্রাণ জাগিয়ে! "
-এই যে কবি সাহেব?
:জ্বি বলুন অরুনা।
-আপনার হাতে এ গুলো কি?
:ও হ্যাঁ আপনার তো আজকে জন্মদিন,শুভ জন্মদিন আর এই গুলো আপনার জন্য।
-ধন্যবাদ, কিন্তু আপনি জানলেন কেমনে?আর আমি না আসলে এই গুলো কি করতেন?
( ওরা যে ভাবে কথা বলছে মনে হয় কত পরিচিত।কিন্তু আজই প্রথম কথা বলা। আসলেই সত্যিকারের আর প্রাপ্ত বয়সের ভালোবাসা গুলো এমনই হয় )
:হাহা আপনার বাবা বলেছেন,আপনি দেখি কিছুই জানেন না! আর গোলাপ গুলো আপনার নরম বালিশটার মাথায় রেখে আসতাম।
-কিন্তু আপনার কি মনে হয়,যে আমার হাতে মার না খেয়ে আপনি চলে আসতেন?
:হুম, কারণ আমি জানি,আপনিও এটাই চান যে জোছনা রাতটা যেন দেরিতে না হয়।

কিন্তু অরুনা কি জানে জোছনা রাতটা অনেক দিন পরপর হয় বলেই এত দাম এর?
হুম!অরুনা এখন বুঝতে পারলো তার বাবার মুচকি হাসির রহস্য।কোথা থেকে যেন এক ফোঁটা চোখের জল উপরের ঠোঁটটা কে স্পর্শ করল
:আরে আপনি কাঁদছেন কেন? 
বলেই চোখের জলটা মুছে দিয়ে অরুনার হাত দুটি নিজের হাতে বন্দী করে নিলো নির্বাণ!
আর অরুনার চোখ রাঙানি দেখেই ছেড়ে দিয়ে কান ধরে বলল, সরি অরুনা!
-আচ্ছা ঠিক আছে,তবে তিনটা কাজ এখন করতে হবে। একটা গোলাপ আমার চুলে পড়িয়ে দাও,আমার হাত দুটা তোমার হাতে বন্দী করো আর শেষের কবিতার শেষ ৫ লাইন বলবে।
:আচ্ছা শোনো,
"হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান :
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু ভালোবাসি।
তোমায়"।
-এই হয়নি, তুমি একটা ফাজিল!
:হাহা 
দুজনই হেসে ওঠে, সত্যি কারের ভালোবাসায় বলতে হয় না ভালোবাসি। শুধু দরকার চোখ আর মনের গভীরতা বোঝার ক্ষমতা।
কেউ যদি ভালোবাসি কথা শুনতে চায়, তুমি চিৎকার করে না বলে একটা কবিতার লাইন ভুল করে বলেও; বলে দিতে পারো ভালোবাসি। সে তো ছুতো খুঁজবেই রাগ করার তাই বলে কি সে তোমায় ছোঁবে না? 

জানালার পর্দা সরে গেছে।নিরুপম রায় দাঁড়িয়ে দেখছে,দুজন তরুণ তরুনী হাতে হাত রেখে জোছনা দেখছে পুকুরে।কি সুন্দর করে জলে জোছনা পড়ে আর তা কত সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে জলে!রাত বাড়ে,জোছনাও বাড়ে।বাতাসের মাঝে কথাও ছড়ায় অনেক দূর,সাথে খিল খিল হাসির শব্দও।এটাও ভালোবাসার তৈরি একটা রহস্য।



-রেজাউল করিম

Post a Comment

0 Comments